স্বরলিপি। আগাগোড়া একজন লেখক হলেও পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালে পেয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার। এবার পেলেন কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২৪। সম্প্রতি তার লেখালেখি, সাহিত্য ভাবনা, পুরস্কার প্রাপ্তি এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় সাহিত্য সাময়িকী 'উন্মেষ'র সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত।
উন্মেষ : কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২৪ পেলেন, আপনাকে শুভেচ্ছা। কেমন আছেন? পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আপনার অনুভুতি কি?
স্বরলিপি : ধন্যবাদ। খুব বেশি ভালো নেই। মেয়ে অসুস্থ। চারদিন হলো হসপিটালে ভর্তি। তাকে হসপিটালে রেখেই এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। অন্যদিকে কয়েকদিন আগে রাজধানীতে ‘মাইলস্টোন ট্রাজেডি’র মতো ঘটনা ঘটে গেছে। চাইলেই ভালো থাকা যাচ্ছে না, আবার প্রয়োজনীয় কাজগুলো ফেলেও রাখা যাচ্ছে না। অনেক শিশু প্রাণ হারিয়েছে, মিডিয়ার সুবাদে আহত, নিহতদের স্বজনদের নানা বিলাপের ভিডিও সামনে আসছে; অজান্তেই আমরা এক বেদনার ঘোরে ডুবে আছি। এই সময়ে পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি একদিকে মেঘাচ্ছন্ন অন্যদিকে পুরস্কার হলো বিচারকদের মূল্যায়ন। আমি মনে করছি এই সম্মাননা আজ এবং আগামীতে সৃজনে আত্মবিশ্বাস যোগাবে।
উন্মেষ : আপনার লেখালেখির শুরুটা কীভাবে হলো? ‘স্বরলিপি’ নামটিই কেন বেছে নিলেন?
স্বরলিপি : এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর লিখতে শুরু করি। ‘স্বরলিপি’ নামটা নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের দেওয়া। আমার ডাকনাম লিপি।
উন্মেষ : ‘নিষিদ্ধ মুদ্রার ফসিল’ ও ‘নির্বাসিত দৃশ্যের অরণ্য’— এই দুই গল্পগ্রন্থে পাঠক কী ধরনের সমাজ বা মনস্তাত্ত্বিক চিত্র খুঁজে পাবে বলে আপনি মনে করেন?
স্বরলিপি : ‘নিষিদ্ধ মুদ্রার ফসিল’-এর ভাষা ও তরঙ্গ আমি আমার দেখা মানুষের অভিব্যক্তি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছি। দেখা বাস্তবতার ভেতর থেকে অল্প দেখা বাস্তবতা যেগুলো দীর্ঘদিনের বিশ্বাস নাড়িয়ে দিতে পারে-সেসব বিষয় তুলে আনার চেষ্টা করেছি। যেমন—‘ইউসুফ সরকারের শেষকৃত্য’ গল্পটি একটি লাশ দাফন করার জটিলতা নিয়ে শুরু হয়। গ্রামে কোনো লাশ দাফনে সমস্যা দেখা দিলেই স্থানীয়রা নানাভাবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। গল্পটি এখানে থামিয়ে না দিয়ে বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। লেখক হিসেবে সৃজনে এই স্বাধীনতা পাওয়া দারুণ উপভোগ্য বলে মনে হয়।
অন্যদিকে মানুষের বিবর্তনও নিষিদ্ধ মুদ্রার ফসিলের উপজীব্য। আর ‘নির্বাসিত দৃশ্যের অরণ্য’ এর কথা যদি বলি তাহলে ঘটনা হলো ধীরে বয়ে চলা নদীর মতো। কিন্তু সেই নদীর ঢেউ মানুষকে তলিয়ে যেতে দেয় না, ভাসিয়েও রাখে না। তারপরেও মানুষ প্রবল ইচ্ছা জাগিয়ে রাখে আরও বেশি মানুষ হয়ে ওঠার জন্য।–এই দুই গল্পগ্রন্থে পাঠক কি খুঁজে পাবেন, তা আসলে পাঠক ভালো বলতে পারবেন। যেহেতু আমি কবিতা লিখি, সুতরাং অনিবার্যভাবে গল্পগুলোও নৈব্যক্তিক হয়ে ওঠে। সেহেতু পাঠক চাইলে গল্পগুলো নিজের মতো করে ভাবনার রঙে রাঙিয়ে নিতে পারবেন।উন্মেষ : আপনি কবিতাও লেখেন। ‘মৃত্যুর পরাগায়ন’ একটি দারুণ শিরোনাম— কবিতা ও গল্পের ভেতর আপনি কী পার্থক্য অনুভব করেন একজন লেখক হিসেবে?
স্বরলিপি : গল্প আর কবিতা একেবারেই আলাদা। তবে একে অন্যের ওপর কখনও সহায়ক কখনও প্রতিযোগীতামূলক প্রভাব ফেলে। কবিতা অনেক কিছু অল্প কথায় বলে আর গল্প এক একটি চরিত্রের মাধ্যমে প্রবাহিত হতে হতে বিশালতার বা বৃত্তের দিকে যায়।
উন্মেষ : সাহিত্যে আপনি কী ধরনের থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন? আপনার লেখার ভাষা অনেকটাই সংবেদনশীল— সেটা সচেতন কোনো প্রয়াস কি?
স্বরলিপি : যা বলতে চাই তা বলার জন্য আমাদের সমাজ পেক্ষাপট কতটুকু সুযোগ রেখেছে— এ বিষয়েতো ভাবতেই হয়।
উন্মেষ : আপনি ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন। পুরস্কার পাওয়ার পর লেখালেখির অভিজ্ঞতায় কোনো পরিবর্তন এসেছে কি? পুরস্কার কি আপনার দায়িত্ববোধ বাড়িয়েছে?
স্বরলিপি : পুরস্কার প্রাপ্তি একজন লেখকের বিশেষ করে তার আশপাশের মানুষগুলোর কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে পারে, তাহলো- ‘তাকে লিখতে দিন।’ এই মানুষগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, যিনি লিখছেন তিনি একেবারে কম গুরুত্বপূর্ণ নন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, পুরস্কার অবশ্যই আত্মবিশ্বাস এবং দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দেয়।
উন্মেষ : লেখালেখির সময় আপনি কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেন? আপনার লেখার রুটিন কেমন?
স্বরলিপি : কোনো বিষয় বা চিন্তা মাথার ভেতর রূপান্তর হতে হতে কোনোটা গল্প আবার কোনোটা কবিতায় রূপ নেয়। এরপর লিখি। যেহেতু আমি দুই সন্তানের মা। আমার দুই কন্যা নিশাত মেহেরিন এবং নূরী মোনালিসা দুইজনই ছোট। ওদেরকে প্রচুর সময় দিতে হয়। এজন্য ভোরে লিখি। যখন ঘরের সবাই ঘুমিয়ে থাকে-তখন আমার লেখার সময় হয়। অন্যান্য সময়ে টুকরো টুকরো চিন্তাগুলো সম্ভব হলে ছোট আকারে লিখে রাখি।
উন্মেষ : বর্তমান বাংলা সাহিত্যে আপনি কোন বিষয়গুলোতে বেশি আশাবাদী, আর কোন জায়গাগুলোতে ভাবনার অবকাশ আছে বলে মনে করেন?
স্বরলিপি : বর্তমানে ননফিকশন নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। এই প্রবণতা আমাদের আত্মপরিচয় নামক যে বৃক্ষ তার শেকড় কোথা থেকে জল পায়, জীবনীশক্তি আহরণ করে-সেই সব বিষয়ে জানার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তবে আমাদের দেশে সাহিত্য সমালোচনার জায়গাটা সেভাবে তৈরি হয়নি।
উন্মেষ : নারী লেখক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? সাহিত্যে নারীর স্বর কতটা স্বাধীন এখনো?
স্বরলিপি : একজন লেখক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, চিন্তাশীলতা জারি রাখতে হয়। আর এই কাজটি করতে গিয়ে বাস্তব সমাজে একজন লেখক কিছুটা খাপছাড়া মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেতে পারেন। কখনও কখনও বাস্তব জগৎ এবং চিন্তা জগৎয়ের মাঝে সামঞ্জস্য করা কঠিন হয়। আর তখনও চারপাশ খানিকটা বিরূপ মনে হতে পারে। আপনি প্রশ্ন করেছেন, নারীর স্বর কতটা স্বাধীন— আমি বলবো যে মোটাদাগে নারীর আছে স্বাধীনতার পরাধীনতা আর পরাধীনতার স্বাধীনতা। এর বাইরে শুধুই স্বাধীনভাবে কথা বলা কঠিন, কঠিন এবং কঠিন।
উন্মেষ : তরুণ লেখকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? বিশেষ করে যারা সাহিত্যে আসতে চায়, কিন্তু দ্বিধায় ভোগে।
স্বরলিপি : তারুণ্য হচ্ছে অদম্য। আর যে অদম্য তার জন্য কোনো পরামর্শ লাগে না। তারুণ যদি জেনে যান, তিনি কিসে অপ্রতিরোধ্য। সেই জানাটাই ঠিক করে দেয়, তাকে আসলে কি করতে হবে।
উন্মেষ : আপনাকে ধন্যবাদ।
স্বরলিপি : আপনাকেও ধন্যবাদ।
0 Comments