Advertisement

উন্মেষ

ছয় নম্বর প্রশ্নের উত্তর : সৈয়দ আব্দুল মালিক

অনুবাদ : বাসুদেব দাস

প্রথম প্রশ্ন – কবিতা কাকে বলে? অসমিয়া আধুনিক কবিতার বিষয়ে কী জান লিখ।
দ্বিতীয় প্রশ্ন – সাহিত্য বলতে কি বুঝ?
তৃতীয় প্রশ্ন…
চতুর্থ প্রশ্ন…
পঞ্চম প্রশ্ন…

ষষ্ঠ প্রশ্ন– রচনা। নিচের যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে একটি রচনা লিখ–
ক) অভাবই আবিষ্কারের মূল।
খ) তোমার জীবনের লক্ষ্য।
গ) কলেজে তোমার প্রথম দিন।

হরিহর প্রশ্ন পত্রটি দুবার ভালো করে পড়ে দেখল। এটাই কলেজে দেওয়া তার প্রথম পরীক্ষা –প্রথম টার্মিনাল। সমস্ত পরীক্ষার্থীরই প্রথমে প্রশ্ন পত্রটি পেলে প্রশ্নগুলি বুঝতে পারছে না বলে মনে হয়। হরিহরেরও প্রথমে সেরকমই মনে হল। সে পুনরায় ভালোভাবে প্রশ্নগুলোর উপরে চোখ বুলালো। প্রশ্নগুলি ক্রমে তার সহজ বলে মনে হতে লাগল। কোর্স বেশি পড়ানো হয়নি। তাই সাধারণ প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। হরিহরের প্রশ্নপত্রটি খুব একটা কঠিন বলে মনে হল না। হরিহরের একটা কথা মনে পড়ল, অধ্যাপক বলেছিলেন। যে প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে জানা আছে, সেই প্রশ্নটি প্রথমে লিখে নিতে হয়।

হরিহর চিন্তা করে দেখল। কোন প্রশ্নের উত্তর লেখা তার পক্ষে সবচেয়ে সহজ হবে। সে অনুভব করল যে ছয়টি প্রশ্নের ভেতরে তার জন্য ষষ্ঠ প্রশ্নটি সবচেয়ে সহজ হবে। রচনা সে লিখতে পারবে। আর তিনটি রচনার ভেতরে তৃতীয়টি লেখাই তার পক্ষে অধিক সহজ হবে– সে ভাবল। ’কলেজে তোমার প্রথম দিন’। সেই দিনটির অনেক কথা – প্রায় সমস্তই তার মনে আছে। রচনাটা সে ভালোভাবে লিখতে পারবে বলে অনুভব করল।

বসে থাকার মতো সময় নেই। তিন ঘন্টার ভেতরে ছয়টি প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে। সবগুলি না পারলেও অন্তত চারটি প্রশ্ন এটেম্পট করতেই হবে।
কিছুটা ভেবে নিয়ে হরিহর ষষ্ঠ প্রশ্নের উত্তর লিখতে শুরু করল।

‘কলেজে আমার প্রথম দিন।’
আমার কলেজে আসার তিন মাস হল। জুলাই মাসের ২৭ তারিখ আমি কলেজে নাম লিখিয়েছিলাম। সেদিনই ছিল কলা বিভাগের ছাত্রদের কলেজে নাম লেখানোর শেষ দিন। অন্যান্য প্রায় সমস্ত ছাত্রই আমার চেয়ে আগে নাম লিখিয়েছিল। আমি শেষে এসে নাম লিখিয়েছিলাম।
কারণ–
তার আগে আমি কলেজে নাম লেখাতে পারলাম না।
আমরা তিন ভাই এবং দুই বোন। আমাদের বাড়ি গ্রামে। বাবা চাষ করেন– অন্যের জমিতে। আমাদের নিজেদের জমি মাত্র তিন কাঠা। আমাদের বসবাস করা ঘরটি আমাদের নিজেদের জমির ওপরেই আছে। চাষের জমি নেই। অন্যের জমিতে চাষ করে যে ধান পায় তা দিয়ে আমাদের চার মাসের মতো খাবার জোটে। তারপরের বাকি আট মাস খুব কষ্ট হয়– বড়ো কষ্ট। আশ্বিন, কার্তিক মাস আমরা সারাদিনে কোনো রকমে একবেলা মাত্র খাবার পাই। কখনও কখনও সেটাও জোগাড় হয় না। মা লোকের জমিতে কাজ করে। মায়ের চুলগুলি পেকে গেছে। লোকেরা মাকে দেখলে বুড়ি বলে ভাবে।

আমি দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাশ করলাম। প্রথম বিভাগে পাশ করব বলে আমিও ভেবেছিলাম, আমার শিক্ষকরাও আশা করেছিল। পারলাম না।
কারণ–
পরীক্ষার জন্য পড়া হল না। আমার পরীক্ষার সময় মায়ের কঠিন অসুখ হল। সুবিধাজনক চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থা করা গেল না, সাধারণ টোটকা চিকিৎসা করা হল। চার মাস ভুগলেন–মৃত্যু হল না। মারা গেলে আমাদের আরও অসুবিধা হত।

মায়ের চিকিৎসায় লেগে থেকে আমি পড়াশোনা করতে পারলাম না। তাছাড়া–আমার বইপত্র ছিল না। এর ওর কাছ থেকে দু’দিনের জন্য চেয়ে এনে কোনমতে পড়েছিলাম। বেশি রাত পর্যন্ত পড়ার কোনো উপায় ছিল না। অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বালিয়ে পড়াশোনা করার মতো তেলের জোগাড় ছিল না। আর ছিল না ভাত। মায়ের ওষুধ পত্রের জন্য অন্য কোনো পথ না পেয়ে ধান বিক্রি করতে হয়েছিল। বিক্রি করার মতো আর কিছুই ছিল না। বাড়ির ভিতরে আমরা মানুষগুলি ছাড়া আর  কিছু ছিল না। আজকাল কেউ মানুষ কেনে না। কিন্তু আমার মনে হয় মানুষ বেচাকেনা করা প্রথাটা  আজকের দিনেও চালু থাকলে খুব একটা খারাপ ছিল না, তাহলে হয়তো আমাদের মুখের ধানের মুঠো বিক্রি না করে হয়তো আমাকে বা আমার কোনো একটি ভাইকে বাবা বিক্রি করে দিতে পারত। আর সেই টাকা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা করা যেত।

আমি মেট্রিক পাশ না করলেই ভালো ছিল। পাশ করার পরে প্রত্যেকেই বলতে লাগল আমাকে আরও পড়াশোনা করতে হবে, কলেজে নাম লেখাতে হবে। আমিও বহুদিন থেকে দেখে আসা স্বপ্নটা পুনরায় একবার নতুন করে দেখতে লাগলাম।

বাড়ির অবস্থা দেখে কলেজে পড়তে গেলে গ্রাম থেকে দূরে থাকতে হবে, ভালো না হলেও  দুই তিন  ধরনের জামা কাপড় লাগবে। দেখতে পাচ্ছি, এই সমস্ত কিছুর জোগাড় বাবা কিছুতেই করতে পারবে না। গ্রামে থাকা সম্পর্কীয় মানুষগুলি প্রত্যেকেই আমার মতোই দুঃখী, আমার পড়াশোনায় সাহায্য করা তো দূরের কথা–নিজেদেরই সংসার চলে না। তথাপি তারাও আমাকে পড়াশোনার জন্য উৎসাহ দেয়। আমি আশা নিরাশার মধ্যে দোলায়িত হয়েছিলাম– কী করব, বিশেষ চিন্তা না করে চাষের কাজে ঢুকে পড়লাম। অন্যের জমিতে হলেও হাল না বেয়ে একমুঠো অর্জন না করলে আমরা কী খাব? পড়াশোনা হয় যদি হবে না হলে নেই–চাষের সময় অপেক্ষা করবে না।
 
মেট্রিক পাশ করে, কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে অন্যের ক্ষেতে হাল চাষ করতে যেতে দেখে বাবা খারাপ পেয়েছিল, অবশ্য মুখ খুলে কিছু বলতেও পারছিল না। আমার নিজেরও খারাপ লাগছিল। কিন্তু দরিদ্রের ভালোলাগা খারাপ লাগার কোনো অর্থ নেই। জীবন সংগ্রাম করতেই হবে, সুতরাং অন্যান্য সহপাঠীরা যখন কলেজে যেতে প্রস্তুত হয়েছিল, তখন আমি অন্যের জমিতে চাষ করার জন্য মাঠের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম।

জুলাই মাসের একুশ তারিখ মাঠ থেকে এসে ঘরে প্রবেশ করেছি। সেদিন বড়ো কড়া রোদ ছিল। শ্রাবণ মাস। জল খাবার খেয়ে, মাটির ওপরে দুব্বো ঘাসে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। মা বলল, ‘টাকার জোগাড় হয়ে গেছে। তোকে আর হাল বাইতে হবে না। পড়াশোনা করার জন্য প্রস্তুত হ।‘
প্রথমে মায়ের কথা বুঝতে পারলাম না, পড়াশোনার কথা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। ছাত্র জীবন শেষ হয়ে গেল বলেই ভেবেছিলাম। মা যেন আমি বুঝতে না পারা একটা রূপকথার গল্প বলছে।

আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মা বুঝতে পারল আমি মায়ের কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। কারণ অভাবই আবিষ্কারের মূল কথা প্রবাদটি কোনো ধনী মানুষের সৃষ্টি, দুঃখীরা কোনোদিন কিছু আবিষ্কার করেনি, করতে পারেনা। একটা কথা, একটি সত্য কেবল দুঃখীরাই আবিষ্কার করে, করতে পারে যে সে দুঃখী, দুঃখ তার চিরসঙ্গী, দুঃখই তার জীবনের একমাত্র সত্য। কিন্তু এটা আবিষ্কার করে দুঃখীদের দুঃখ আরও বেশি হয়, লাভ হয় না।

মাকে জিজ্ঞেস করলাম,’ টাকা কোথায় পেয়েছিস মা?’
‘যেভাবেই হোক জোগাড় করেছি, তবে তা দিয়ে হবে কিনা সেটা বলতে পারছি না।’
মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। কান দুটি খালি। কানের দুল জোড়া নেই। বিক্রি করেছে না বন্ধক দিয়েছে? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হল না। বিক্রি করলেও কি কলেজে নাম লেখানোর মতো টাকার যোগাড় হবে?
বিকেলে দেখতে পেলাম আমাদের ছাগল তিনটিও নেই। 
‘ছাগলগুলি নেই দেখছি, কোথায় গেল?’ বোনকে জিজ্ঞেস করলাম ।
‘বিক্রি করে দিয়েছে–’
‘কবে বিক্রি করল?’
‘গতকাল বিক্রি করেছে। তিনটির জন্য সাতাশ টাকা পেয়েছে।’
‘সবগুলি কেন বিক্রি করে দিল?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘না হলে টাকা জোগাড় কীভাবে হবে?’ অর্থাৎ আমার কলেজের নাম লেখানোর টাকা। 
ছাগলের শূন্য খামারটার দিকে একবার তাকিয়ে আমি ভেতরে চলে এলাম। 
কলেজে পড়াটা কী ধরনের জানিনা। কিন্তু পড়ার জন্য করা আয়োজন দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। অবশ্য আমার মনে কিছু আশা জাগল, হয়তো নাম লেখানোর জন্য টাকার জোগাড় এভাবেই হয়ে যাবে।

কাকুর ছেলে কণপায়ও আমাকে কিছুটা সাহায্য করল।আমার কিছু পুরোনো বই ছিল–কিছু অচল হয়ে যাওয়া পাঠ্য বই, কিছু আমি স্কুলের প্রাইজ পাওয়া বই, ক্লাসে আমি প্রায়ই প্রথম হতাম।
সে বইগুলি পুঁটলি বেঁধে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে নিয়ে টাউনে গেল। তেরো কেজি হল। সেগুলো বিক্রি করে নয় টাকা পেল।

অবশেষে–আমি দেখে আশ্চর্য হলাম–বাবা এবং মায়ের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আমার কলেজে নাম লেখানোর জন্য টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। এমনকি তিন টাকা বেশি হল। সেটা আপাতত আমার আসা-যাওয়ার খরচ হবে।
অবশ্য এখন পর্যন্ত কেউ ভাবতেই পারেনি যে কলেজের নাম লেখানোর পরে কীভাবে চলব–কোথায় থাকব– কোথায় খাব। প্রসঙ্গটা উত্থাপন করতেও আমার ভয় হল। মায়ের কানের জোড়া বিক্রি করে, ছাগল খামারের ছাগল বিক্রি করে, পুরস্কার পাওয়া বই বিক্রি করে মা বাবার মুখে যে হাসি ফুটেছে, কে জানে হয়তো এই সমস্ত প্রশ্নের উত্থাপন করলে হঠাৎ সেই হাসি নাই হয়ে যেতে পারে। আশ্চর্য শহরের নতুন জীবন। হবে কোনো উপায়, নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। নগরে কত মানুষ কত কী করে চলছে। আমিও কিছু একটা উপায় বের করে নিতে পারব না কি? নাম লেখানোর টাকা জোগাড় করা যেতে পারে, ভবিষ্যতের উপরে বিশ্বাস রাখতে ইচ্ছা হল।

আমার সামনে আমাদের গ্রামের কোনো ছেলে কলেজে পড়তে যায়নি। আমাদের পাশের গ্রামের মানিক পড়েছে–দ্বিতীয় বার্ষিকীতে। একদিন গিয়ে মানিকের সঙ্গে আলোচনা করলাম। মানিক সাহস দিল, ‘প্রথমে নামটা লিখিয়ে আয়, অন্য ব্যবস্থা ধীরে ধীরে হতে থাকবে।’
‘বইপত্র?’
‘বর্তমানে না হলেও চলবে। নোটগুলি লিখে রাখবে।’
‘থাকার ব্যবস্থা?’
‘কোনো মেসের খোঁজ করতে হবে। আমি খুঁজে দেব।’
মানিকের কাছে কৃতজ্ঞতা অনুভব করলাম।
অবশেষে ঠিক হল যে বাসে মোটরে গিয়ে টাকা তিনটি খরচ করা থেকে, দু’দিন বা তিন দিনের জন্য কাকার সাইকেলটি নিয়ে যাই। সতেরো মাইল পথ, থাকার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক না হলে বাড়ি থেকেই যাওয়া আশা করতে হবে, আসা যাওয়ায় চৌত্রিশ মাইল হবে।

সাতাশ জুলাই। আমার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিন। আমি কাকাবাবুর সাইকেলটা নিয়ে নগরের কলেজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব।
আগের দিন রাতে কারও ভালো করে ঘুম হল না।
পিসি এল, পিসির মেয়ে আইধানো এল। মা, আমার বোন খুব হুলস্থুল করে কিছু চিড়া কুটল, পিঠে ভাজল, আর জানি না আমার শুভযাত্রার জন্য আরও কী কী আয়োজন করেছে? হয়তো এরই মধ্যে মা বাবার মাধ্যমে কিছু পূজা প্রার্থনারও ব্যবস্থা করেছে।

রাতের বেলায় কণপা কাকাবাবুর পুরোনো সাইকেলটা মুছে একটা রেন্স দিয়ে কিছু কিছু জিনিস টাইট-ঢিলা করে সাইকেলটা নির্বিঘ্নে কলেজ পার হয়ে যাবার মতো করে রাখল। একটা টায়ার ফাটা ছিল। সেটা খুলে, ভেতরে ফাটা টায়ারের একটা টুকরো ঢুকিয়ে দিল। আমার কাপড়-চোপড় দুই সেটও নেই। ধুতি অবশ্যই দুটি, কিন্তু একটি ফেঁসে গেছে, সেলাই করা সম্ভব নয়। মাঝে মধ্যে গিঁট দিয়ে নিই। অন্যটি এতটা ফাটেনি, কিন্তু খুব ভারী। আর শার্ট মাত্র একটা। কলার ফেটে গেছে। ওপরের পকেটের কাছেও ফাটা। বোন সেলাই করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আইধান থাকার জন্য লজ্জা পেল।

সমস্যা হল জুতো নিয়ে। জুতো না পরেই মেট্রিক পাশ করলাম। কিন্তু কলেজে খালি পায়ে যেতে কিছুটা সংকোচ হল। ভাবলাম এখন কার কাছে চাইতে যাব? এভাবেই যাব– যে যা ভাবে ভাবুক। 
কিন্তু রাত দশটার সময় বাবা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে বাঁধা একজোড়া পুরোনো স্যান্ডেল আমার দিকে এগিয়ে দিল।
‘এটা পায়ে হবে কিনা দেখতো—’
আমি একবার বাবার মুখের দিকে আরেকবার স্যান্ডেল জোড়ার দিকে তাকালাম।
‘না হলেও চলে যেত। এই জোড়া কার?’
‘শিরীষ ঘোষের।’
শিরীষ ঘোষ আমাদের গ্রামের বাঙালি দোকানি। পায়ে ঢুকিয়ে দেখলাম, বড়ো হচ্ছে। 
বললাম হবে, ঠিকই আছে।
বাবা বললেন, ’ছিড়বি না। আবার ফিরিয়ে দিতে হবে। তারও আর নেই।’
ঘুমোতে রাত দুপুর হল। কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারিনা। কোনো স্বপ্ন দেখে থাকলে মনে নেই।
ভোরের দিকে মা জাগিয়ে দিল।
বাবা তখন গোয়ালঘর থেকে গরুর সঙ্গে লাঙ্গলটা নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বাবা বললেন ’তুই তাড়াতাড়ি যা, দেরি করিস না, টাকাগুলি সাবধানে রাখবি। আবার ফিরে আসবি তো?’
‘সম্ভব হলে আসব।’
‘সম্ভব হলে চলে আসবি। না হলে আমাদের নিয়ে চিন্তা হবে। আমি যাই, কণ ঠাকুরের জমিতে কাজ রয়েছে।’ বাবা বললেন। 
চিড়া পিঠার পুঁটলিটা সাইকেলে ঝুলিয়ে বেঁধে দিল বোন। জল খাবার দিয়েছিল–খেতে পারলাম না, মুখে দিলাম মাত্র। 

একটা তামোল মুখে দিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালাম। দেখি কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে বাবা দাঁড়িয়ে রয়েছেন–মা ছেঁড়া ছাতিটা এনে দিল, কণপা সাইকেলের পাম্পটা এনেছিল, সঙ্গে একটু ছেঁড়া কাপড়–কানেকশন ভালো নেই। ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোটা পকেটে ভরিয়ে নিলাম। পিসি দুটো তামোল দিল। আইধান আমার দিকে তাকিয়ে আনন্দ বিস্ময় মিশ্রিত হাসি হাসল।

জামার পকেটে টাকাটা হাত দিয়ে অনুভব করলাম–আছে। এতটা টাকা আমি জীবনে প্রথমবারের জন্য পেয়েছি। প্রত্যেককে বলে বেরিয়ে এসে বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছলাম। সবাই আমার পিছন পিছন এল। মা বলল, ’রোদ লাগলে ছাতাটা মেলে নিবি। আজ খুব কড়া রোদ উঠবে।’
বাবা বলল ’তুই চিন্তা করিস না। নামটা লিখিয়ে নে। পড়ে কোনো একটা ব্যবস্থা করব।’

ছোটো বোনটি কাছে এসে বলল, ’দাদা, আমার জন্য একটা পেন্সিল আনবি। আমারতো পেন্সিল নেই।’
যাত্রা আরম্ভ করলাম। 
সাইকেলের প্যাডেল দুটো বড়ো টাইট। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা হল–সাইকেলের সামনের চাকাটা, প্রায় দেড় মাইল দুই মাইল যাওয়ার পরে চাকার হাওয়া চলে যায়। নেমে পথের পাশের একটা গাছে হেলান দিয়ে পুনরায় হাওয়া ভরে নিই। মাঝেমধ্যে পথের পাশে সাইকেল মেরামতির দোকান দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু টিউবের ফুটো সারাই করতে গেলে অনেক সময় লাগবে। আর পয়সাও খরচ হবে। খরচ করার মতো পয়সা এবং সময় দুটিরই আমার অভাব। প্রায় চার ঘন্টা পরে আমি নগরে প্রবেশ করলাম। কড়াা রোদ উঠেছিল। ঘামে আমার জামা কাপড় ভিজে গিয়েছিল। ক্লান্ত লাগছিল। কলেজ পাওয়ার আধমাইল আগেই সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম। রুমালটা দিয়ে হাতমুখ ভালো করে মুছে নিলাম। ক্ষুধা পেয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু কোথাও বসে নিয়ে জলখাবার খাওয়ার মতো জায়গা দেখতে পাচ্ছিলাম না। তখন হাজার হাজার মানুষ নগরের দিকে চলেছে। ঠিক করলাম আগেই কলেজে গিয়ে নামটা লিখিয়ে নিতে হবে, তারপর সুবিধা হলে কিছু একটা খাব।

সামনের চাকায় শেষবারের মতো হাওয়া ভরে পুনরায় সাইকেলে উঠলাম। খুব একটা দেরি হয়নি। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা পথ ঘাট ভরে ফেলেছে। আমি সাইকেলটা ধীরে ধীরে চালাতে লাগলাম।
অবশেষে–
অবশেষে এসে কলেজের গেটের সামনে দাঁড়ালাম। সাইকেল থেকে নেমে এলাম, হাতের তালুতে মুখটা একবার মুছে নিলাম। আমার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না, কথাটা ভেবে আমি কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলাম। একটু ইতস্তত করে, সাইকেলটা রেখে আমি কলেজের অফিসে ঢুকে গেলাম। 
‘এতদিন কী করছিলে?’ কিছুটা কঠিন কন্ঠেই কেরানি বলল। আর পূরণ করার জন্য একটা ফর্ম এগিয়ে দিল। আমি এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখলাম–পরিচিত কেউ চোখে পড়ে নাকি? 
অফিসের প্রায় প্রত্যেকেই আমার দিকে খুব কৌতূহলের সঙ্গে দেখছে বলে মনে হল। আমি ঘামতে শুরু করলাম। মুখ কান লাল হয়ে উঠল, আমি নার্ভাস হয়ে পড়লাম। অবশেষে তারাই ফর্মটা পূরণ করায় সাহায্য করল। টাকা দিলাম, একটা রশিদ দিল। আজ থেকে আমি কলেজের ছাত্র হলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে এসে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলাম। সবাই কলরব করতে করতে ক্লাসে যাচ্ছে। ক্লাস থেকে আসছে–যেন কোন উৎসব চলছে। 

আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ক্লান্ত লাগছে, ক্ষুধা পেয়েছে, নার্ভাস অনুভব করছি। কিন্তু কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমার কাছে জীবনের যা সবচেয়ে বড়ো কথা, অন্যের কাছে সেটা কোনো ব্যাপারই নয়। আমি হতাশ অনুভব করলাম। বড়ো নিরুৎসাহিত বলে মনে হল।

মেয়েদের মুখে উজ্জ্বল হাসি। যেন বিয়ে হচ্ছে, কোনো উৎসব চলছে, যুবক-যুবতিরা তার জন্য সেজেগুজে এসেছে। আমার অকারণ সংকোচ বোধ হতে লাগল–যেন ওদের সঙ্গে আমার মিশ খায় না। আমি অনুভব করলাম যেন এতগুলি ছেলের মধ্যে আমার মত দরিদ্র আমার মতো দুর্ভাগা কেউ নেই। এই উৎসবে যোগ দিতে আসাটা আমার পক্ষে যেন অশোভন হয়েছে।

ছেলে মেয়েদের পেছন পেছন একটা ক্লাসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেটা কোন ইয়ারের কী ক্লাস আমি কিছুই জানিনা। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও সংকোচ হচ্ছিল। আমি ক্লাস চিনি না বললে ছেলেরা আমাকে কী ভাববে। পেছনের একটি বেঞ্চে চুপ করে বসে রইলাম। আমার পাশে বসা ছেলেটি একবার আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকাল। আমিও তাকালাম। হাতে একটা রেজিস্টার নিয়ে একজন আধবয়সী মানুষ ক্লাসে প্রবেশ করল। ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও উঠে দাঁড়ালাম। বুঝতে পারলাম ইনিই প্রফেসর।

আমি প্রফেসরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চুলগুলি ছোটো করে ছাঁটা, আধপাকা, চুলে তেল নেই। ভালো করে চুলটাও আঁচড়ান নি। তিন চার দিনের না কাটা আধ পাকা দাড়ি। তাঁর চোখে একজোড়া চশমা।

তিনি একটা পুরোনো কুর্তা পরেছেন–কাঁধের কাছটা ছেঁড়া–কলারটা ছেঁড়া এবং মলিন। আমার মনে হল–মানুষটা যেন আমার চেয়েও বেশি ক্লান্ত–আমার চেয়েও বেশি দরিদ্র। তাকে দেখে আমার সাহস হল, মানুষটার প্রতি ভক্তি হল। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল তিনি পরে থাকা স্যান্ডেল জোড়া আমার পরে আসা শিরীষ ঘোষের স্যান্ডেল জোড়া থেকেও পুরোনো।

তিনি হাজিরা নিলেন, কী সব বক্তৃতা দিলেন –আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি কিন্তু অনুভব করলাম যেন ক্লাসটিতে আর কেউ নেই। মুখোমুখি হয়ে বসে আছি আমি এবং সেই আধবয়সী প্রফেসরটি। আমাদের মধ্যে যেন বহুদিনের একটি আত্মীয়তা আছে। আমি না বললেও তিনি যেন আমার সমস্ত কথা জেনে ফেলেছেন, আমার দুরবস্থার কথা, আমার ক্ষুধা পাওয়ার কথা, ক্লান্ত লাগার কথা, আমার সমস্ত কথা।

ক্লাস শেষ হল। অন্যদের সঙ্গে আমিও বাইরে বেরিয়ে এলাম। এবার অনুভব করলাম যেন ছেলে মেয়ে প্রত্যেকে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে–আমার ছেঁড়া জামাটার দিকে, আমার পুরোনো বড় ঢিলা স্যান্ডেল জোড়ার দিকে, আমার ক্ষুধার্ত শুকনো মুখের দিকে। আর প্রত্যেকেই যেন মুখ টিপে হাসছে। মেয়েরা যেন আমাকে নিয়ে গোপন উপহাস করছে। আমার কান মাথা গরম হয়ে উঠল। আমার খুব জোরে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা হল।

ধীরে ধীরে আমি সাইকেলটার কাছে গেলাম, আগের চাকাটার হওয়া নাই হয়ে গেছে। বিরক্ত হলাম, ছেলে মেয়েদের সামনে সাইকেলে হাওয়া ভরতে লজ্জাও হল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। পুনরায় ছেলে মেয়েরা ক্লাসে গেল। ভিড়টা একটু কমতেই আমি দ্রুত সাইকেলটা ঠেলে কলেজ কম্পাউন্ড থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

কিছুদূর এসে একটা গাছে সাইকেলটা হেলান দিয়ে হাওয়া ভরে নিলাম। সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটা মানুষ কয়েকটি ছাগলের গলায় রশি লাগিয়ে টেনে আনছে। তার হাতে একটা লাঠি। আমার বুকটা ব্যথা করে উঠল। এগুলি যেন আমাদের ছাগল। আমি আর ওদের দিকে তাকাতে পারলাম না, কারণ ছাগল গুলির চোখের অসহায় কাতর চাহনিটা আমার অসহ্য মনে হতে লাগল। আমি সাইকেলে উঠলাম।
‘এটাই কলেজে আমার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা।’

এই প্রশ্নটি লেখার পরে হরিহর প্রথম প্রশ্নটির উত্তর লিখতে শুরু করল, ’কবিতা কাকে বলে?’
উত্তর হিসেবে সে লিখল, ’কবিতা কাকে বলে আমি বলতে পারি না, কারণ কবিতা আমি পড়েছি, কবিতা কী জিনিস সেই বিষয়ে জানার কোনো সুযোগ আমার জীবনে কোনোদিন আসেনি, কারণ….’

লেখক পরিচিতি: অসমিয়া কথাসাহিত্যের অন্যতম রূপকার সৈয়দ আব্দুল মালিক ১৯১৯ সনে অসমের শিবসাগর জেলার নাহরণিতে জন্মগ্রহণ করেন। যোরহাট সরকারি হাইস্কুল থেকে পাশ করে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এমএ করেন। পরবর্তীকালে যোরহাট জেবি কলেজে অধ্যাপনা করেন। লেখকের গল্প সঙ্কলনগুলির মধ্যে ‘পরশমণি’, শিখরে শিখরে’, শুকনো পাপড়ি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘অঘরী আত্মার কাহিনী’ উপন্যাসের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।


Post a Comment

0 Comments