Advertisement

উন্মেষ

বিজু পীয়ারের হাসি এবং স্বাধীনতার গল্প

onubad golpo unmesh sahittya

অনুবাদ–বাসুদেব দাস

আজ কিছুদিন থেকে লোকটি এরকম হয়ে গেছে। তিনি  হাসতে ভুলে গেছেন। ভুলে গেছেন  মানে তিনি হাসতে ভয় পাচ্ছেন। অন্য মানুষ হাসলেও তিনি প্রায়ই দূরে সরে থাকেন নতুবা বিশেষ কোনো কাজে ব্যস্ত থাকার ভান করেন। নাকি সত্যিই ব্যস্ত থাকেন সেটা অবশ্য নিশ্চিত নয়। তিনি নিজেও জানেন না আসলে তিনি ব্যস্ত না অনবরত ব্যস্ততার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে তার মধ্যে মজে থাকতে ভালোবাসেন। সেসব যাই হোক না কেন এ কথাটা ঠিক যে তিনি হাসতে ভুলে গেছেন।

–কীহে কলিতা, এত চিন্তা কিসের? আজকাল একেবারে মনমরা হয়ে থাকেন দেখি? হাসাটা দরকার জানেন তো? মানুষকে সব সময় হাসতে হয়।
–না, না! কোনো মন খারাপ না। ঠিকই আছি।

কলিতা নিজে সত্যিই ঠিকই আছে বলে ভাবে। তাঁর সমস্যাটা হল তিনি হাসতে পারছেন না। তার কোনো অসুখ-বিসুখ, দুর্যোগ দুর্ঘটনা হয়নি। তবু তিনি হাসতে পারেন না। হাসতে থাকা মানুষদের দেখেও তার হাসি পায় না। কিছুটা উদাসীনতা নতুবা কিছু একটা বিরক্তিতে তিনি অন্যের হাসি গুলি একা একা বিশ্লেষণ করে দেখতে চান।

কলিতার শৈশবে তাদের গ্রামে তার প্রায় সমবয়সী একটি ছেলে ছিল। ছেলেটি ছিল বড়ো সরল। ছোট বড় প্রত্যেকই তাকে যখন তখন খ্যাপাত। তার নাম ছিল বিজু। তার উজ্জ্বল দাঁতগুলি কালো মুখটায় দূর থেকেই জ্বল জ্বল করত। তার সমবয়সীরা তাকে ’বিজু পীয়ার’ বলে খ্যাপাত। ’বিজু পীয়ার’ বললে তার খুব রাগ হত। কিন্তু রাগ করা অবস্থায় তার উজ্জ্বল দাঁতগুলিতে যে হাসি, মনে ফুর্তি থাকা অবস্থাতেও তার হাসিটা একই রকম বলে মনে হত। উজ্জ্বল দাঁত গুলির জন্য তাকে তারা হাসিমুখ বলত। কলিতার সমস্যা হল ’বিজুর উজ্জ্বল দাঁতগুলিতে তার মুখটাতে অনবরত লেগে থাকা হাসিটা তিনি এখন চারপাশের মানুষগুলির মুখে দেখতে পান। তার কাছে এখন তার আশেপাশে থাকা প্রতিটি মানুষের হাসিটা ’বিজু পীয়ারের হাসি…। কলেজে যেতে থাকা মেয়েটির হাসিটা, তার অফিসের বসের হাসব না হাসব না করতে থাকা মুখের হাসিটা, বিয়ে বা পার্টিতে সাজগোজ করে বেরিয়ে যাওয়া অভিজাত মানুষগুলির হাসি…দিন হাজিরা করা মহিলাটির হাসি, চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে দিতে চাকরি না পাওয়া বেকার যুবকটির হাসি–প্রতিটি হাসিতে কলিতা ’বিজু পীয়ারের’ ক্ষীণ আর দুর্বল শরীরের কালো মুখটাতে অনবরত লেগে থাকা উজ্জল দাঁত গুলির হাসিটা দেখতে পান। কলিতা মাঝে মধ্যে ভাবেন–তার কি কোনো অসুখ করেছে নাকি? হাসলেই লোকগুলিকে তাঁর ‘বিজু পীয়ার’ বলে মনে হয়’ আর বিজু পীয়ারের মুখটা, সেই বৈচিত্রহীন মুখটা দেখে তিনি বিরক্ত হন। 

সব হাসিই কীভাবে বিজু পীয়ারের হাসি হতে পারে–কলিতা ভেবে পান না।

*  *  *  *

সবখানেই স্বাধীনতা উৎসব উদযাপনের ব্যাপক প্রস্তুতি।পরিবর্তনের আশায় মজে থাকা লোকগুলি আজকাল প্রতিটি উপলক্ষকে উদযাপন করতে শিখেছে। নতুন শিক্ষার্থীদের উদ্যমে জাতীয় পতাকার চাহিদা বাড়িয়েছে। মিসেস বরুয়া, ডেকা এবং শ্রীমতী চৌধুরী এক একটি ছোট ছোট পতাকা হাতে নিয়ে অফিসে প্রবেশ করছে। তিনজনেরই বাড়িতে ছোটছোট ছেলেমেয়ে আছে। বাজারে ছোট-বড় অজস্র জাতীয় পতাকা–

তিন বর্ণের জাতীয় পতাকা
নীল আকাশে নাচে 
ওপরে গেরুয়া মাঝখানে সাদা 
নিচে শ্যামলা আছে

কলিতা গুণগুণ করল। নয়না বরুয়া, প্রতিভা ডেকা এবং আলপনা চৌধুরী ছোটো ছোট পতাকাগুলি তুলে ধরে ফটোর জন্য পোজ দিয়েছে। চম্পা মিসেস বরুয়ার মোবাইলে ফটো তুলছে… ’স্মাইল প্লিজ’ ... চম্পার কণ্ঠস্বরে কলিতা চমকে উঠল। হ্যাঁ, হ্যাঁ; ঐ যে পুনরায় বিজু পীয়ার হাসছে। বরুয়া ,ডেকা আর চৌধুরীর ঠোঁটে বিজু পীয়ারের হাসিটা লেগে আছে–বিজু পীয়ারের স্থির হাসিটা।

*  *  *  *
                                             
স্বাধীনতা আমাদের উৎসব, বাৎসরিক উৎসব। এইবার বাৎসরিক উৎসব উদযাপনের সমস্ত আয়োজন নষ্ট করার জন্য অসময়ের বন্যা এল। কলিয়াবর, জখলাবন্ধায় রাস্তাঘাটে ঘর বানিয়েছে মানুষ। টিভির মানুষের সামনে; এমডি-এর মানুষের সামনে, সরকারি অফিসারের সামনে, বিদ্রোহী নেতার সামনে ও’রাস্তার ওপরেই ঘর বানিয়ে থাকার’অনুভব ব্যাখ্যা করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ধর্মেশ্বর। এদিকে ধর্মেশ্বরের চিন্তা তার বাড়ির জন্য, জলে ডুবে থাকা তার বাড়িটার না জানি কী হল? রাত দুটোর সময় সে নিজেই কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। হুলুস্থূল, চিৎকার চেঁচামেচি, কান্নার মধ্যে জয়ন্তী তাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। সে ছেলেমেয়ে দুটিকে কোলে তুলে নিয়ে এক এক করে ভাঁড়ার ঘরের চাঙে উঠিয়ে দিয়েছিল। জয়ন্তী হাত পা না ধুয়ে চাঙ্গে উঠতে সংকোচ করছিল। মুহূর্তের মধ্যে এক কোমর জল হয়ে গেল। চাঙটাতে দশবারের মতো স্পর্শ করে সেই হাত  কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলছিল ’ভগবান দোষ ধর না।’ তারপরে ওরা রাস্তার ওপরে ঘর পাতল। ধর্মেশ্বর পরের দিন কলা গাছের ভেলায় চড়ে ছেড়ে আশা বাড়িটা দেখতে গেল। তার লাঙ্গল জোয়াল বন্যার জল ভাসিয়ে নিয়ে গেল, জয়ন্তীর তাঁতশাল, ছোট ভাঁড়ার ঘরে থাকা ধানের মুঠো গুলি জলের নিচে বোধহয় পচতে শুরু করেছে। যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাসছে অসংখ্য জিনিসপত্র। প্লাস্টিকের নানা রঙের  গ্লাস বাটি, কোথাও চিপসের ফাটা প্যাকেট… ওই যে একটা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে… একটা মৃত গরুর ফুলে ওঠা পেটে লেগে একটা সসপ্যানের আধা অংশ জ্বলজ্বল করছে। কুড়িয়ে নেবার মতো, সামলে নেবার মতো অবকাশ নেই। বাগানের একটি গাছে কিছুটা গোলাপি রঙ দেখতে পেল ধর্মেশ্বর। মেয়েটির স্কুল ব্যাগটা নতুন কিনেছিল সে। বাগানের মিষ্টি কুমড়ো বিক্রি করে এবার ভালোই টাকা পেয়েছিল। গোলাপি স্কুল ব্যাগটা এবং এক বাক্স রং পেন্সিল, রং করতে পারা ছোট বড় ফল ফুল এবং জীবজন্তু এঁকে রাখা খাতা… গোলাপি ব্যাগটা, রংগুলি এবং খাতা দুটি নিয়ে মেয়ের কী স্ফর্তি। সে লাফিয়ে লাফিয়ে মাকে, দাদাকে, পাশের পুতুল কাকাকে, দুধের খোঁজে আসা মাকণের মাকে, মাছ বিক্রি করতে আসা রঙিলীকে রং গুলি দেখিয়ে বেড়াচ্ছিল। সেই গোলাপি ব্যাগটা। জলে ভিজল। গাছটাতে লেগে আছে। একটা লতায় লেগে ব্যাগটার কিছুটা বেরিয়ে আছে। ধর্মেশ্বর ব্যাগটা ভেলায় উঠিয়ে নিল।

মেয়ে কাঁদছে। গোলাপি ব্যাগটা থেকে তার বই খাতাগুলি, তার রং পেন্সিল বের করতে না পেরে ব্যাগটা দেখে দেখে সে চিৎকার করে কাঁদছে। নেই নেই, ব্যাগটার ভেতরে ডিজে পুঁটলি হয়ে যাওয়া কাগজ গুলি… চোখ কচলাতে কচলাতে মেয়ে কথা বলতে পারছে না। কয়েকজন ক্যামেরা পার্সন দৌড়ে দৌড়ে আসছে… ঐ যে হাতে মাইক্রোফন নিয়ে একজন চিৎকার করে বলছে– ’এই দেখুন, একটি শিশু তার বইপত্রের ব্যাগটি বন্যায় ভেসে যাওয়ায় কাঁদছে। এই যে চিৎকার করে করে কাঁদছে।’

*  *  *  *
                                                 
গলায় তেরঙা জাতীয় পতাকার আদর্শে সেলাই করে নেওয়া দীর্ঘ কাপড়টা ঘিরে নিয়ে পাঞ্জাবি কুর্তা পড়ে দশ বারোজন যুবক এসেছিল। গম্ভীর কণ্ঠে তাঁদের একজন সরকারের চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে গালিগালাজ করল। গায়ে গেঞ্জি না থাকা, ছেঁড়া হাফপেন্ট পরে থাকা ছেলেমেয়েদের ফটো তুলল। একটা চাদর দিয়ে আড়াল সৃষ্টি করে রীতার বৌ শিশুটিকে দুধ খাওয়াচ্ছিল। একজন সেদিকে গিয়ে ফটো তুলল। মানুষটা চাদরটা টেনেটুনে শরীরটা ঢাকার চেষ্টা করছে। শিশুটা গরমে ছটফট করে চাদরটা টেনে সরিয়ে দিচ্ছে। উৎসব এবং উদযাপনের ধরনগুলি বোধহয় পরিবর্তিত হয়েছে। ধর্মেশ্বর বহু কথা বুঝতে পারে না। তার বিশৃঙ্খলা লেগে যায়-আজকাল বন্যাও বোধহয় একটা উৎসব এবং উৎসবগুলি উদযাপন করতে শিখতে হয়। কথাটা ভেবেভেবে তার কিন্তু ভেসে যাওয়া লাঙল-জোয়ালজোড়া, তার অত্যন্ত প্রিয় বলদ দুটি, গরু দুটি, জয়ন্তীর তাঁতশালটা, মইনার ক্রিকেট ব্যাট এবং বলগুলি, মায়ের গোলাপি ব্যাগটা এইসবই চোখের সামনে ভাসতে থাকে। এতগুলি মানুষের সঙ্গে এখানে ঘর বেঁধে আছে-কয়েকদিন পরে জল শুকিয়ে যাবে। কোথায় যাবে সে, তারপরে? কী খাবে? খাওয়াবে কী? ভেসে যাওয়া বাড়িটা কীভাবে সে ফিরিয়ে আনবে? মাঠটা, গরু বাছুরগুলি, বাড়িটা, চাষবাস নিয়ে সে এত সুখী ছিল? কোথা থেকে সে কুড়িয়ে নেবে সেই সুখ?

*  *  *  *

অফিসে ঢুকেই জগদীশ দুয়ারা আরম্ভ করলেন, ‘এগুলি সব এক একটি নাটক বুঝেছেন, নাটক! সেই ফটোগুলি দেখেছেন? ফেসবুক, হোয়াটসএপে ঘুরে বেড়ানো সেই ফটোগুলি। বাঃএপিক ফটোগ্রাফ নাকি সেটা! সেই যে খালি গায়ে এক হাঁটু, এক কোমর জলে নেমে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দৃশ্য! কেউ আবার বাড়ির ছাদের ওপরে উঠে, টিনের ছাদের ওপরে উত্তোলন করছে অখণ্ড ভারতের জাতীয় ঐক্যের ধ্বজা বহনকারী জাতীয় পতাকা! গায়ে দেবার জন্য এক টুকরো কাপড় নেই, কিসের স্বাধীনতা উদযাপন। আগে রাজ্যের মানুষদের শরীর ঢাকার জন্য একটুকরো কাপড় দে। ’দুয়ারার এটাই নিয়ম। অফিসে ঢুকেই এরকম একটি বিষয়ে চিৎকার চেঁচামিচি করে প্রত্যেকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। হো হো করে হাসল দুয়ারা-সরকারের নাটক এবং স্বাধীনতার নামে নাটকের প্রচারের দোহাই দিয়ে। দুয়ারার এই সশব্দ হাসিটাতে কলিতা বিজু পীয়ারের হাসিটাও দেখতে পেল। কলিতাকে দেখতে দেখতে পুনরায় হাসল দুয়ারা, ‘কী হে কলিতা; কই চোখ কান বুজে থাকেন আপনি? হবে না বলছি, আজকের যুগে এতটা সেলফিস হলে চলবে না। ’না না। কলিতা রাগ হয়নি, দুঃখও পায়নি। কেবল তিনি হাসতে পারেননি। দুয়ারার সশব্দ হাসিতাতে বিজু পীয়ারের স্থির হাসিটা আঠা লেগে ধরেছে। ক্রোধ, দুঃখ, কষ্ট, নির্বিশেষে একই সেই ‘বিজু পীয়ারের হাসি’। বিজু পীয়ারের শীর্ণ শরীরটার কালো মুখটিতে লেগে থাকা হাসিটা।

*  *  *  *

স্ত্রী মণিমা সকালবেলা উৎসাহ নিয়ে কলিতাকে মেয়ের ফটো দেখিয়েছিল। স্থানীয় খবরের কাগজে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের বিভিন্ন ফটোর মধ্যে ওদের স্কুলের দেশপ্রেমমূলক নৃ্ত্যের ফটো। দুদিন ধরে মণিমা ভীষণ ব্যস্ত। মেয়ের স্কুলে জেলা উপায়ুক্তের কার্যালয়ের স্বাধীনতা দিবসের কার্যসূচিতে অংশ নেবে।এটা কি কম কথা? মণিমা মেয়ের জন্য ‘অরেঞ্জ কালার দোপাট্টা’র খোঁজে সারা বাজার ঘুরে বেড়িয়েছে- ‘মিস বলেছেন এই দোপাট্টার রঙটা এত ভালো। ‘সাদা কুর্তা এবং সবুজ লেগিংসটা মণিমা আগে থেকেই সেলাই করে, কিনে রেখেছে। পার্টটাইম করা মেয়েটিকে আগের দিন বাড়ির চাবি দিয়ে বলে রেখেছে, ‘গীতা তুই এসে কাজটা করে রাখবি। আমরা ইন্ডিপেন্সডের প্রোগ্রামে যাব।’ গীতা সায় দিয়েছিল।

মেয়ের  ফটো দেখিয়ে উৎফুল্লিত মণিমার  হাসিটাও কলিতার’ বিজু পীয়ারের হাসি বলে মনে হচ্ছিল। পার্টটাইম করা মেয়েটিকে সেদিন কলিতা বলেছিল গীতা,  তোকে কাল আসতে হবে না। স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবি।’  মনি মা চিৎকার করে উঠেছিল,’ কী ফাজলামি করছ? আগামীকাল আমি কতটা ব্যস্ত থাকব তুমি কি বুঝবে? নিজেতো নিজের ভাবের জগতে থাক?  ইস বড়ো মহানতা দেখাতে এসেছে।– গীতা স্বাধীনতা দিবসের কী বোঝে?’ স্যার এই ধরনের মাঝে মাঝে মজা করে এবং  দিদি রাগে গড় গড় করে ওঠে। গীতার হাসি উঠে,’ এই সমস্ত বড়ো মানুষগুলি কীসব ছেলেদের মতো হাসি ঠাট্টা করে! যাবার সময় গীতা মনিমাকে জিজ্ঞেস করেছিল,’ দিদি আগামীকাল কি কোনো বড়ো পূজা আছে? আমাদের বাড়ির কাছে কেউ কেউ তেরঙা একটা কাপড় দিয়ে আগামীকাল ছেলে ছেলেমেয়েদের সভায় যেতে বলেছে।’

–’ না পূজা নয় স্বাধীনতা দিবস। পতাকা। জাতীয় পতাকা? তুই এটাও জানিস না?’

গীতা হাসল। কিছুই বলল না। তার এত কথা জেনে কি লাভ? দুটো বাড়িতে কাজ করে ঠিকমতো পয়সা গুলি পেলে সে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে পারবে। এর চেয়ে কিছু ভালো হতে পারা যদি থাকে সে জানে না। মাজুনীর নাচের প্রোগ্রাম হয়ে যাবার পরে সেদিন মণিমা দিদি তাকে তিনটি খাওয়ার জিনিসের প্যাকেট  দিল। তার মধ্যে মিষ্টি সিঙ্গারা, একটি কলা এবং একটি ম্যাংগো ফ্রটির প্যাকেট। গীতা হাসল। এতগুলি খাবার জিনিসের প্যাকেট বাড়িতে নিয়ে গেলে ছেলেটি কম খুশি হবে? গীতা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গিয়েছিল।

স্বাধীনতা দিবসের দিন গীতার এই হাসিটা  কলিতার  খুব একটা ভালো লাগল না। এমনিতেও তিনি নিজে আজকাল আর হাসতে পারেন না। অন্যের হাসি গুলিতে তিনি কেবল বিজু পীয়ারের হাসিটাই দেখতে পান। গীতার হাসিটাও তিনি দেখতে দেখতে বিজু পিয়ারের উজ্জ্বল দাঁতের অপরবর্তনীয় হাসিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। গীতা গেটটা খুলে বেরিয়ে গেল এবং বিজু পীয়ারের হাসিটা কলিতাকে কষ্ট দিতে থাকল।

*  *  *  *

২৫-৩০ বছর আগের কথা… কলিতা এবং বিজু পীয়ার একসঙ্গে স্কুলে দৌড়ে যাচ্ছে। ১৫ আগস্টের পতাকা উত্তোলন, এদিকে মেঘ  গর্জন করছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তথাপি ওরা দৌড়াচ্ছে। মূল গেট দিয়ে ঢুকলে দেরি হবে, একটা শর্টকাট নিয়ে যথাসময়ে  ফিল্ডে উপস্থিত। এদিকে আরম্ভ  হয় হয়– জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা’। ভাগ্য ভালো, ওরা গানটা গাইতে পেল। গানটা গাইতে না পেলে হেড স্যার বুট মুগের ভাগটা কখনও দেবে না। সেই বুটগুলির তৃপ্তির স্বাদ এবং স্কুলে জনগণমন গাওয়ার স্মৃতি এখনও বুকে বহন করে বেড়ায় কলিতা। সেই জন্যই বোধ হয় কলিতা অফিসে বলেছিল– ’এবার আমরা পতাকা উত্তোলনের পড়ে বুট এবং ফলমূল খাব না হলে।‘ হো হো করে হেসে ফেলেছিল সবাই– সেই একই বিজু পীয়ারের হাসি। কৌশিক ভরদ্বাজ হাসতে হাসতে বলল, ’কলিতা তুমি কিন্তু বড়ো পুরোনো দিনের মধ্যে বাস কর। আজকাল বুট মুগ কে খাবে? অবশ্য সন্ধ্যাবেলা সাইড ডিস হিসেবে ব্যবস্থা করে যেতে পারে, একটা চোখ বাঁকা করে ভরদ্বাজ হাসতে হাসতে  পুনরায় বলল, ’ কিন্তু ইন্ডিপেন্ডডেন্স সেলিব্রেশনের নামে সরকার এত টাকা পয়সা খরচ করছে, ভালোভাবে চা মিষ্টির আয়োজন করা উচিত, সম্ভব হলে লাঞ্চের আয়োজনও করা যেতে পারে, জনতা কী বলে? জ্যৈষ্ঠ বিষয়া কৌশিক ভরদ্বাজের হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল। কলিতা মানুষের মুখগুলি একদিক থেকে দেখে গেল। দুয়ারা, বরুয়া, ডেকা, বরা, ভরদ্বাজদা, নমিতা শর্মা, প্রতীক্ষা চৌধুরী– প্রতিটি মুখের রং, আকৃ্তি, চেহারা এতটা একই–এতগিলি বিজু পীয়ার, এতগুলি বিজু পীয়ারের হাসি।

*  *  *  *

ফেসবুক, হোয়াটসএপ গড়িয়ে আসা খবর এবং ফটোগুলি দেখতে দেখতে অফিসে সহকর্মীরা দুঃখ করে,মহান মহান কথা বলে। সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাস মুখস্থ থাকার মতো দুই একজন দার্শনিক পন্ডিতের বাক্য উদ্ধৃতি দেয়। বাড়িগুলিতে, বৈঠকখানা ঘরে, ডাইনিং টেবিলে বন্যা, বিদ্যুৎপ্রবাহে মৃত্যু হওয়া লোকের আলোচনা হয়। আলোচনাগুলি দীর্ঘ হলেই খাওয়া টেবিলটা বিস্তৃত হয়। যেভাবে সরকারি বেসরকারি কর্মশালাগুলিতে দীর্ঘ ভাষণের শেষে একটা সুন্দর লাঞ্চ বা ডিনার থাকে। গভীর চিন্তা চর্চায় মগজের পরিশ্রম হয়। সুস্বাদু খাদ্য এই পরিশ্রমের পরিপূরক। কেউ একজন উদাত্তকন্ঠে বলেছিল, ’এই সরকারের কোনো কাজ নেই, এখানে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে। এখন মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। এখন আমরা বাস্তবে বেঁচে নেই। আমাদের প্রয়োজন এক একটি প্রতীক। বাস্তবের চেয়েও এক একটি প্রতীক আমাদের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রধানমন্ত্রীর গলায় গামছা লওয়াটা অসমের আদর্শ বিদ্যালয়ে অসমিয়া মাধ্যমের শিক্ষকের দক্ষতার অভাবে নিযুক্ত না হওয়া কথাটার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বন্যায় সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের খাবার জিনিস, কাপড়ের জোগান ধরার চেয়ে ফটো উঠিয়ে খবরের কাগজে, সোসিয়েল মিডিয়ায় মেলে দেওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ’কেউ বলেছিল কলিতা গুরুত্ব দিল না। কলিতার জন্য আজকাল সমস্ত হাসি এবং সমস্ত ক্রোধই বিজু পীয়ারের মুখে লেগে থাকে। বিজু পীয়ারের দুর্বল শরীরের কালো মুখটাতে জ্বলজ্বল করতে থাকা দাঁতগুলির জন্য তাকে অনবরত হাসতে থাকা বলে মনে হচ্ছিল। ক্রোধ, দুঃখ, আনন্দ সবকিছুতে হাসিটা যেন বিজু পীয়ারের মুখটাতে লেগে ছিল। মানুষগুলির মুখগুলিতে বিজু পীয়ারের মুখটা দেখে কলিতা হয়রান হয়ে যায়। মানুষগুলি কি এত বৈচিত্র্যহীন!

হ্যাঁ হ্যাঁ এই মানুষটি এই মানুষটি সেদিন বাহাদুরকে গায়ের গেঞ্জিটা খুলে গাড়িটা মুছে দিতে বলেছিল। বড় অফিসারের গাড়িটা পরিষ্কার করে রাখতে হবে। স্বাধীনতা দিবসের সকালবেলা বাহাদুর স্যারের গাড়ি মোছার জন্য একটা কাপড় চাইল। ’তোর গায়ের গেঞ্জিটা খুলে মুছে দিবি’ বলল অফিসার। বাহাদুরের মেয়েটি দ্বিতীয় বিভাগের মেট্রিক পাশ করে কলেজে পড়ে। সাফাই কর্মীদের বাহাদুরকে অফিসের কয়েকজন টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিল। কলিতা দেখেছিল রীমা বরা মেয়ের পুরোনো কাপড় কয়েক জোড়া মেয়েটির জন্য বাহাদুরকে দিয়েছিল। বাহাদুর রীমা বরার পায়ে হাত দিতে চেয়েছিল। বাহাদুরের যুবতী মেয়ে কলেজে গেছে। বাহাদুর আজকাল সব সময় একটি শার্ট পরে আসে। শার্ট খুলে গেঞ্জি পরে সাফাইয়ের কাজ করে। গেঞ্জিটা খুলতে বলায় সে ভয় পেল। দুঃখ নয়, ভয়। অন্য একটি গেঞ্জি কিনতে হলে তার বাড়ির লোকজনকে একবেলা উপোসে থাকতে হবে। অফিসারটি হাসল। হাসিটা কলিতা দেখেছিল। কলিতা বিজু পীয়ারকে দেখব না বললেও যেখানে সেখানে দেখতে পেল। বিজু পীয়ারের হাসিটা কলিতাকে অনবরত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াল।

*  *  *  *

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কলিতার অসুখই হয়েছে। হাসি দেখতে না পারা অসুখ, হাসতে না পারা অসুখ এবং হাসিগুলি চুলচেরা বিশ্লেষণ করার অসুখ। চেতিয়ার স্ত্রী হেমা কারও সঙ্গে কথা বলছে। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিনে নেওয়া কিছু রং বেরঙের চুড়ি দেখিয়ে হাসছে হেমা। হেমার হাসিটা গড়িয়ে যাচ্ছে নগেনের বিধবা স্ত্রী পর্যন্ত। দুজনেই কথা বলতে বলতে অপেক্ষা করছে। ’এই চুড়ি, মণি, কানের দু্‌ল নাগপাশা লাগে অনেক জিনিস, ’হরেকমালের অনেক জিনিস’  বলে সুরেলা কণ্ঠে ফেরিওয়ালা কোথায় পৌছে গেল। রংবেরঙের চুড়িগুলো হাতে ঢুকিয়ে বের করে নগেনের বিধবা স্ত্রীকে দেখাতে থাকা হেমার হাসিটা বিজু পীয়ারের হাসিটা হয়ে কলিতাকে বিরক্ত করতে শুরু করেছে। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে এসে প্রতিরাতে স্ত্রীর ওপরে শারীরিক অত্যাচার করা চেতিয়াকে হেমা সকালবেলা এই হাসি দিয়েই কাজে পাঠায়। রাত হলে হেমা প্রায়ই কান্না জুড়ে দেয়। আর দিনের আলোতে হাসে, এভাবেই হাসে। হেমার হাসি, নগেনের স্ত্রীর হাসি বিজু পীয়ারের হাসি হয়ে কলিতার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।

*  *  *  *

বিজু পীয়ারের  হাসি থেকে পালানোর জন্য টিভিটার সূইচে হাত দিল কলিতা। ব্রেকিং নিউজ বিশেষ খবর আজকের আলোকপাত… গলা পর্যন্ত জলে নেমে খালি গায়ে অথবা মাথায় লাল টুপি এবং গালে দাড়ি নিয়ে পতাকা উত্তোলনের দৃশ্য, গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা অথবা দেশপ্রেমের ব্যাখ্যা… টিভিতে বড়বড় শব্দের আলোচনা। কোথায় আমাদের স্বাধীনতা? ধর্ষিতা নারীর জন্য মোমবাতির আলো নিয়ে প্রতিবাদ। কালো কাপড়, কালো পতাকা নিয়ে স্বাধীনতার প্রত্যাহ্বান। এটা গণতন্ত্র– যেখানে কেবল বেঁচে থাকার স্বাধীনতা ও  সংকটে। কেবল অম্লজানের অভাবে তিন কুড়ি শিশুর নিঃশ্বাস বন্ধ। 

মাত্র বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নিঃশ্বাসের স্বাধীনতা না থাকা গণতান্ত্রিক দেশটিতে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের বিশাল আয়োজন। লালকেল্লা, খানাপারা তেরঙা স্বাধীনতা ছুঁতে পেরেছে কি বন্যার জলে বই খাতা হারিয়ে  বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকা কিশোরীটিকে? সরকারের সর্বশিক্ষা প্রবেশ করবে কি লছমি, মিনি, রমিলাদের বস্তিগুলোতে? টিভির পর্দায় হাতে ছোটছোট জাতীয় পতাকা নিয়ে দৌড়াতে থাকা ছেঁড়া  জামা, হাফপ্যান্ট পরা ছেলেমেয়েগুলি দেখে কলিতা স্থির হয়ে গেল। পর্দায় জ্বলজ্বল করে উঠছে ওদের ছোট ছোট দেহগুলি, কাদা জল লেগে থাকা হাত পাগুলি হাতে এক একটি জাতীয় পতাকা–তেরঙ্গা। ওরা হাসছে। টিভি ক্যামেরার সামনে ওদের হাসি এবং স্ফুর্তি  উপচে পড়ছে।  কলিতা অনুভব করছে বিজু পীয়ার আবার এসেছে। একটি সেই স্থির বৈচিত্র্যহীন হাসিটা নিয়ে এই যে বিজু পীয়ার একেবারে কাছে চলে এসেছে। দুঃখ- কষ্ট, ক্ষোভ, বেদনা, বিরাগ– এই সব কিছু সময়ে একই সেই ‘বিজু পীয়ারের হাসিটা তাকে এখন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, নিরন্তর তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

------

লেখক পরিচিতি: ড. জুরি দত্ত তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অসমিয়া বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান। তিনি ইংরেজি এবং অসমিয়া ভাষায় তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। মালয়ালম লেখক নারায়ণের ‘কচারেথিঃ আরায়া নারী’ গ্রন্থটির ইংরয়েজি থেকে অসমিয়া অনুবাদের জন্য ২০২২ সনের সাহিত্য আকাদেমি অনুবাদ পুরস্কার লাভ করেন। ‘আনে’ এবং ‘কিউবার উপকূলত সপোন দেখা ছোয়ালীজনী’ লেখিকার দুটি গল্প সংকলন।

Post a Comment

0 Comments