Advertisement

উন্মেষ

স্বনির্মিত বাস্তবসম্মত ও ভবিতব্য পরিবেশ কবির মস্তিষ্কে থাকে : অস্ট্রিক ঋষি

weeklyunmesh
অস্ট্রিক ঋষি। একজন কবি। 'সতীতালয়' বইয়ের জন্য পেয়েছে কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২৪। সম্প্রতি তার লেখালেখি, সাহিত্য ভাবনা, পুরস্কার প্রাপ্তি এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় সাহিত্য সাময়িকী 'উন্মেষ'র সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত

উন্মেষ : কবিতার জগতে আপনার প্রবেশ কীভাবে হলো? লেখালেখির শুরুর সেই সময়টা কেমন ছিল?
অস্ট্রিক ঋষি : জন্মসূত্রেই মানুষ কবিতার জগতের বাসিন্দা। এটা মানুষের জীনগত পাওয়া। কেউ লেখার চর্চা করেন, কেউ পাঠ করেন আর কেউ কেউ এড়িয়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখাতে পারেন। আমি ফাঁদ কাটিয়ে বের হতে পারিনি, ফলে কবিতায় আটকে আছি।

লেখালেখির শুরুর গল্প প্রায় সব কবির ক্ষেত্রে একইরকম। ছন্দ, সুর, চিত্রকলা তথা শিল্পের প্রতি শৈশব থেকেই এক ধরনের আচ্ছন্নতা কাজ করতো। এক সময় খেয়াল করলাম অথবা বলতে পারেন এইসময় এসে বুঝতে পারি যে শৈশবেই ছন্দ আমার কাছে খুব স্বাভাবিকভাবে ধরা দেয়। ফলে যেকোনো সাধারণ কথাও আমি ছন্দে বলতে পছন্দ করে নিলাম। লিখে লিখে খাতা ভরিয়ে ফেলি, নিজের লেখা পড়ে নিজেই অবাক হই, সেই তীব্র আনন্দের বিভোর অনুভূতিটা এখন আর পাই না। জানার পরিধি কম হলে আবিস্কারের আনন্দ বড় হয়ে যায়। ফলে যত দিন যায়, আনন্দের পরিধি ততই কমতে থাকে।

উন্মেষ : ‘অস্ট্রিক ঋষি’— এই ব্যতিক্রমী নামের পেছনের গল্পটা জানতে চাই। কেন এই নাম বেছে নিয়েছেন?
অস্ট্রিক ঋষি : নিজের নাম নিজে ঠিক করাটা বেশ জটিল একটা কাজ। নামের ব্যাপারে ভাবতে গিয়ে মনে হলো এমন একটা নাম ঠিক করবো যার মধ্যে দৃঢ়ভাবে জাতিগত পরিচয় ফুটে উঠবে এবং একই সাথে কবিতার সংযোগ স্থাপন হবে। আমরা সকলেই জানি, 'অস্ট্রিক' বা 'নিষাদ' নামক নৃগোষ্ঠী থেকেই বাঙালি জাতির বিস্তৃতি। আবার 'ঋষি' শব্দের মধ্যে নিহিত আছে ধ্যান। আমার বিশ্বাস— চেতনে বা অবচেতনে একজন কবিও সর্বদা ধ্যানের মধ্যেই থাকেন। 

উন্মেষ : একজন কবি হিসেবে নিজেকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?

অস্ট্রিক ঋষি : আমি মনে করি কবিকে সংজ্ঞায়িত না করাটাই উত্তম। কারণ সংজ্ঞায় প্রচুর সীমাবদ্ধতা থাকে। সংজ্ঞা দিয়ে আপনি কোনোকিছুকেই ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারবেন না। আলাদাভাবে প্রত্যেকটা মানুষের কাছে কবির সংজ্ঞা জানতে চাইলে দেখবেন ৮০০ কোটি সংজ্ঞা দাঁড়িয়ে যাবে। আমি অনুধাবন করি, আমি কবি। যেদিন এই অনুধাবন থাকবে না, লিখে আর তিলমাত্র আনন্দ পাবো না, সেদিন থেকে আর লিখবো না। কিন্তু এটাও এক ঐশ্বরিক ব্যাপার— মানুষ হিসেবে ওইরকম পরম জ্ঞানের পর্যায়ে পৌঁছানো অসম্ভব। ফলে লিখবোই আসলে। অর্থাৎ আমি যতক্ষণ মূর্খ, ততক্ষণ লিখবো। আমি মূর্খ এবং আমি কবি।

উন্মেষ : ‘সতীতালয়’—এই শিরোনামটি আমার কাছে তীব্র প্রতীকধর্মী মনে হয়েছে। এই নামটি কেন নির্বাচন করলেন?

অস্ট্রিক ঋষি : আমার কিন্তু কবিতাগুলো লেখার আগেই নাম ঠিক করা। কারণ কী লিখতে চাই এবং কিভাবে লিখতে চাই তা আগেই আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম। তখনই মনে হলো সতীতালয় নামটা আমার বইয়ের জন্য মানানসই। কিন্তু কোন কোন নির্দিষ্ট কারণে এই নামটি দেয়া হলো তা আমি বলতে চাই না, বলা ঠিকও নয়। যখন কবি নিজে ব্যাখ্যা দিতে যাবেন তখন পাঠকের চিন্তার পরিধি সীমিত হয়ে যায়। আমার মনে হয় বইটি যাঁরা পড়বেন এবং এর প্রকৌশল ও নিহিতার্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন তখন তাঁদের কাছে সতীতালয় নামকরণের উদ্দেশ্য কিংবা যথার্থতা বা অযথার্থতা স্পষ্ট হয়ে যাবে। 

উন্মেষ : আপনার কবিতায় সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস কিংবা আত্মসন্ধান—কোন দিকটি বেশি প্রাধান্য পায় বলে মনে করেন?
অস্ট্রিক ঋষি : এটাও আসলে আমার কাজ না। এটা পাঠক নির্ণয় করবেন। ধরুন আমি একটি রাজনৈতিক কবিতা লিখলাম, কিন্তু পাঠক মনে করলেন এটা প্রেমের কবিতা, তাহলে আমার হাতে তো কিছু রইলো না। থাকেও না। লিখে ফেলার পর কবিতার ভার আর কবির উপর থাকে না, এই ভার পাঠক বহন করেন কিংবা ছুড়ে ফেলেন। তবে কবিতাই আমার একমাত্র রাজনীতি। রাজনীতির বাইরে তো তেমন কিছু নেই আসলে। সমাজ, ইতিহাস, দর্শন, শিল্প, অর্থনীতি সবকিছুই রাজনীতির উপকরণ। আমার রাজনীতিটা আমি কবিতা দিয়ে করার চেষ্টা করি। 

উন্মেষ : কবিতার অনুপ্রেরণা আপনি কোথা থেকে খুঁজে পান—বাস্তব অভিজ্ঞতা, পাঠ, না আত্মচিন্তা?
অস্ট্রিক ঋষি : তিনটির একটি বাদ দিয়েও কবিতা লেখা সম্ভব না। বাস্তব অভিজ্ঞতা তো আমরা প্রতি পলে পলে গ্রহণ করছিই। আমাদের সবই বাস্তব অবিজ্ঞতার ফসল, এমনকি কল্পনাও। কিন্তু পাঠ ছাড়া বুঝতে পারবো না আমাদের সাহিত্য কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, এর গন্তব্য কী হওয়া উচিত। সাহিত্যের ধারাবাহিক ইতিহাস না জানলে নতুন কিছু আবিস্কার করা সম্ভব না। আর কবিতা তো কবির আত্মচিন্তারই আক্ষরিক রূপ। 

উন্মেষ : কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া নিঃসন্দেহে এক বড় স্বীকৃতি। পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভব কেমন ছিল?

অস্ট্রিক ঋষি : সামান্য হলেও কিছু টাকা পাওয়া যাবে, এটা ভেবে ভালো লাগছে। কিন্তু অনুষ্ঠানে আমার পাঠানো বক্তব্যের খন্ডিত অংশ পাঠ করা হয়েছে, যেটা আমাকে মর্মাহত করেছে। অর্থাৎ সেখানেও আমাকে সেন্সরশীপের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। দেখলাম অনুষ্ঠানে সিটি ব্যাংকের এমডি কথাসাহিত্যিক মাশরুর আরেফীন বলছিলেন যে, আমরা যা বলতে চাই তা বলতে পারছি না। আমার মনে হলো উনি আমার পক্ষ থেকেই ব্যঙ্গ করলেন। আমি উনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। যদিও আমার জানার আগ্রহ, আমাদের কখনই বা বলতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ডিফেন্ডার থাকে বলেই গোলের এত মাহাত্ম্য।
তবে সতীতালয় বইকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করাটা আমি মনে করি একটি অত্যন্ত বিপদজনক ও সাহসী সিদ্ধান্ত। কালি ও কলমকে কবি হিসেবে আমার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। 

স্বীকৃতির কথা যদি বলেন তাহলে পুরস্কার অবশ্যই বিভিন্ন ধরনের স্বীকৃতির মধ্যে একটি। একজন পাঠক যখন আমার বইটি কিনছেন, মূল্য পরিশোধের সাথে সাথেই এবং এমনকি ক্রয়ের ইচ্ছা পোষণ করার মাধ্যমেই তিনি একপ্রকার স্বীকৃতি দিচ্ছেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা প্লাটফর্মকে অধিক মূল্যায়ন করি, কারণ সেখানে একটা সংঘ আছে। অর্থাৎ আমরা রাজনীতির মধ্যে ফেঁসে যাই। এই যেমন আপনার সাথে কথা বলছি, এটাও ওই রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা। 

আর পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি যদি বলি তাহলে বলবো, ২ লাখ টাকা পাবো ভেবে ভালো লাগছে। ২০ লাখ পেলে আরও ভালো লাগতো। আমাদের কোটির দিকে যাওয়া উচিত, তাতে রাজনীতিটা আরও শক্তিশালী হয়।

উন্মেষ : আপনি বর্তমান বাংলা কবিতার পরিবেশ ও তরুণদের অবস্থান সম্পর্কে কী ভাবেন?
অস্ট্রিক ঋষি : কবিতার পরিবেশ কেউ ঠিক করে দেবে না। যেকোনো পরিবেশের মধ্য থেকে কবিকে লিখতে হবে এবং নিজের কথাটা বলতে হবে। কাঙ্ক্ষিত পরিবেশের জন্য কবি অপেক্ষা করবেন না। কারণ কবি ইতিহাস জানেন, বর্তমানকে পেরিয়ে যান এবং ভবিষ্যতের কথা তাকে বলতে হয়। একটা স্বনির্মিত বাস্তবসম্মত ও ভবিতব্য পরিবেশ কবির মস্তিষ্কে থাকে। ফলে কবিতায় 'বর্তমান পরিবেশ' নামক কিছু আছে বলে আমি মনে করি না, থাকা উচিতও নয়। বাংলা কবিতায় যেমন নেই, অন্য কোনো ভাষার কবিতাতেও নেই। একইসাথে সব ভাষাতেই কবিতার পরিবেশ সর্বদা সমানভাবে প্রকট।

তরুণদের কথা বলাটা আমার জন্য ঠিক হবে কিনা, কারণ আমিও তরুণদের অংশ। ফলে নিজের সম্পর্কেই কথা বলতে হয়। আমরা অবশ্যই ব্যর্থ। ব্যর্থ বলেই কবিতা লিখতে হচ্ছে। অনেকে লিখছেন। ভালো লাগে। কিন্তু কবি যখন ছত্রছায়ায় গিয়ে দাঁড়ান তখন তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সর্বদাই বিরোধী হয়ে থাকতে পারাটা কঠিন। কিন্তু আপনি কবি, আপনি কেন কঠিনেরে ভালোবাসিবেন না?

উন্মেষ : কবি হলে, কঠিনরে ভালোবাসতে হবে কেন?
অস্ট্রিক ঋষি : আপনি যখন সিস্টেমের ভেতরে বসেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন তখন সেটা তো কঠিনই। কবি কারো দাসত্ব করবে না। সত্য বলবে। আপাত সহজ মনে হলেও রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে এই কাজটিই কঠিন। যদি এটাই কারো কাছে সহজ মনে হয় তবে সেই সহজটাকেও তিনি ভালোবাসতে পারেন। তাঁকে অভিনন্দন।

উন্মেষ : বাংলা কবিতায় নতুন ধারা বা পরীক্ষার জায়গাগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
অস্ট্রিক ঋষি : আপনি যা বলতে চান, যেভাবে বলতে চান তা ঠিকঠাকভাবে বলতে পারছেন কিনা এবং আপনার আগেই সেই কথাটি বলা হয়েছে কিনা। বলা না হলে আপনি ভাগ্যবান, কিন্তু আমার মনে হয় না অতো ভাগ্যবান কেউ হয়। ফলে ভাবনার আঙ্গিককে নাড়িয়ে দিতে পারাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। কবিতা তো সৃষ্টি নয়, আবিষ্কার। নতুন ধারায় পুরাতন জল দিবেন নাকি পুরাতন ধারায় নতুন জল দিবেন সেটা কবিকে বুঝে নিতে হবে। পরীক্ষা অনেকেই করেন কিন্তু সফল হন গুটিকয়েক। আমরা সফলদেরই মনে রাখি। এখনকার কেউ সফল হবেন কিনা, কে কে হবেন তা এখনই বলতে পারি না। পরীক্ষার জায়গার অভাব নেই। এই প্রযুক্তির আগ্রাসনের যুগে এসে আমাদের পরবর্তী পরীক্ষা দিতে হবে প্রযুক্তির বিরুদ্ধে। 

উন্মেষ : নতুন যারা কবিতায় আসতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী হবে?
অস্ট্রিক ঋষি : কবিতায় কেউ আসে না। কবিতা সবার কাছে যায়। কেউ প্রশ্রয় দিতে চায়, কেউ দেয় না। যাঁরা প্রশ্রয় দিতে চান তাঁদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, আপনারা কারোর পরামর্শই শুনবেন না, আমারটাও না। তবে আপনারা চাইলে আমাকে পরামর্শ দিতে পারেন।


Post a Comment

0 Comments