দীলতাজ রহমান-এর জন্ম ১৯৬১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, গোপালগঞ্জের চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে। কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও পাঠকমহলে তার গল্পই বেশি সমাদৃত। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ- ‘বহুকৌণিক আলোর সংঘাতে’, ‘ধূসর আঁচলে চাবি’, ‘বৃত্তভাঙা আয়তন’, ‘মেঘের মেয়েরা’, ‘গহিন দূরত্ব’, ‘নীলকণ্ঠ নাগ’ ‘ফেরার ঘর নেই’ ও ‘গল্পসমগ্র’। শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ : ‘পটলের হারিয়ে যাওয়া’, ‘মা আমার চোখের আলো’, ‘ভালো ভূত’, ‘সোনার মেয়ে করিমন’, ‘একটি পাখি ডাকে’। কাব্যগ্রন্থ : ‘জনকের প্রতিচ্ছবি’, ‘আশ্চর্য সর্বনাশ’, ‘সবুজের সাথে সখ্য’, ‘এ গোলাপ তোমার জন্য’, ‘পারিজাত অপরাজিতা’, ‘রৌদ্রজলে মরীচিকা ঢেউ’, ‘বৃষ্টি এসে’, ‘ওই দুটি চোখ আমার সীমা লঙ্ঘনের ঠিকানা’, ‘রাতান্ধ বিড়াল’, ‘আমি কদম ফুলের ঘ্রাণ চাই’, ‘এ মাটি শেখ মুজিবের বুক’।
কথাসাহিত্যিক দীলতাজ রহমান-এর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক শফিক হাসান। দীলতাজ রহমান-এর জন্মদিনে উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীর পাঠকদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকারের সম্পূর্ণ অংশ নিচে হুবহু তুলে দেয়া হলো।
শফিক হাসান : আপনার গল্প লেখার শুরু কখন, কীভাবে?
দীলতাজ রহমান : আমার লেখা শুরু হয় ছেলেমেয়ের হাতেখড়ির সময়, তাদের ছেঁড়া কাগজ সদ্ব্যবহারের উদ্দেশ্যকে মাধ্যম করে। সেটা মনে করো আমার বাইশ বছর বয়সের ভেতর চার ছেলেমেয়ে। এটা ভাবলে মোটামুটি আমার লেখার বয়স বুঝতে পারবে। তারপর আমার হাজব্যান্ড একবার একটি কাগজের দলামোচড়া ছাড়িয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ইদানীং তুমি যা লিখছো কবিতা হয়ে যাচ্ছে। এগুলো এভাবে ফেলে দিও না। রেখে দাও, বই করে দেবো। তার এই বলাটা ছিলো, হাতেখড়ির বড়টা, মানে আমার বড় ছেলে যখন ইন্টার পড়ে।
শফিক হাসান : গল্প লেখেন কেন?
দীলতাজ রহমান : প্রতিটি মানুষের জীবনে অকথ্য কিছু সত্য থাকে। সেই সত্যগুলোকে গল্পের ভেতর দিয়ে উন্মোচিত করে নিজের ভার লাঘব করা হয়তো। বাস্তবজীবনে যা ছাইচাপা আগুন বা দগদগে ক্ষত...।
শফিক হাসান : কী ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
দীলতাজ রহমান : মানুষের সম্পর্কের যে কোনো একটি খটকা বা গেরো টের পেলে মন সেখানে বাবুই হয়ে যায়। কিন্তু বাবুই পাখি তো খালি বোনে, খোলা সে শেখেনি। গল্পকার আপাত দৃষ্টিতে দেখা কঠিন কোনো বন্ধনকেও একেবারে বুনটের সুতো বেছে, তারও উৎসে নিয়ে তুলোর মতো খুলে দেখাতে পারেন। আমার সেটাই মনে হয় গল্প গড়ার কারিগরদের কারিগরি জ্ঞান সম্পর্কে। অতএব মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে লিখতে আমার ভালো লাগে। আর এতে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিপাশর্^ কী থাকে না অনুষঙ্গ হিসেবে?
শফিক হাসান : পাঠকদের ওপর আপনার গল্পের প্রভাব কেমন?
দীলতাজ রহমান : আমার জানামতে খুবই ভালো। যতটুকু আমি পৌঁছতে পেরেছি। একজন লেখকের লেখা সমাজের সর্বস্তরে পৌছে দেওয়ার জন্য যে প্রোপাগান্ডা চালাতে হয়, আমার বেলায় তার বিন্দুমাত্র ঘটেনি। নিজে উদ্যোগী হয়েও সেরকম কিছু করিনি। আমি বেশ অনেকটা বছর লিখি না। তারপরেও পাঠক একেকটি গল্প পড়ার পর যেভাবে জানায়, সেটা আমার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি, আমি মনে করি।
শফিক হাসান : গল্প লেখার সার্থকতা খুঁজে পান?
দীলতাজ রহমান : পাই না মানে! এই যে লিটল ম্যাগাজিন ‘প্রকাশ’-এর সম্পাদক তুমি একটি সাক্ষাৎকার নিতে এসেছো। এই যে যোগাযোগ, এই গল্পের গতর ছুঁয়ে না থাকলে আমি এক বিচ্ছিন্ন মানুষ। আমি মানুষের সাথে মানুষের পরিচয়ের অবলম্বনকে অনেক বড় করে দেখি। আর সেটা যদি হয় সাহিত্য, যাকে বলে শিল্পের সবক’টি শাখার ভেতর সব চেয়ে উঁচু শাখাটিতে বিচরণ...।
শফিক হাসান : প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজে গল্প পাঠের প্রাসঙ্গিকতা কী?
দীলতাজ রহমান : সাহিত্যই হচ্ছে সমাজের দর্পণ। সমাজ পরিবর্তন হয় দেখেই তো গল্পের বাঁক বদলায়! সেই বদলটাকে যারা সমাজের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না, তারা সেখানেই খর্ব হয়ে পড়বেন। একজন বিখ্যাত লেখক লিখেছিলেন, যে মানুষ সাহিত্য পড়ে না, সে তার নিজেরও অচেনা থেকে যায়। অনেকে এতে দ্বিমত পোষণ করলেও ভালো কিছু আখ্যা তো তাকে দিতে পারবেন না!
শফিক হাসান : একজন পাঠক আপনার গল্প পড়বে কেন?
দীলতাজ রহমান : পাঠককে নিবিষ্ট করে রাখতে যে উপাত্ত প্রয়োজন। যে কোনো ধরনের ঘটনাকে গল্প করে তুলতে কোথাও যেন খেই না হারাই। কোথাও যেন খাপছাড়া না হয়ে যায়, সে প্রচেষ্টা গল্পকার নিজেকে তুষ্ট রাখতেই করেন। আর যা রাঁধুনির কাছে ভালো লাগবে, তা পরিবারের সবার কাছ ভালো লাগবে। দেবতাকে ভোগ দেওয়ার আগে নিজের চেখে দেখার অনুমান শক্তির ওপর ভরসা থাকতে হয়। অতএব আমারও ভরসা আছে, প্রকৃত পাঠক আমার গল্পটি পড়ে শেষ না করে বইটি সরিয়ে রাখবেন না!
শফিক হাসান : গল্প লেখার ক্ষেত্রে যে নতুন ধারা তৈরি হয়েছে, সে প্রেক্ষাপটে আপনার লিখন প্রস্তুতি কী রকম?
দীলতাজ রহমান : শুধু গল্প কেন, যে কোনো শিল্পই তার সময়ের কথা না বলতে পারলে, সে কোনো সময়েরই নয়! যে সৃষ্টির ভেতর সমকাল বিদ্যমান, তা সব সময়ের। আমরা অত্যন্ত পরিবর্তনশীল এক সময়ে নিক্ষিপ্ত। প্রযুক্তি আমাদেরকে স্রােতের মতো ভাসিয়ে নিচ্ছে। আর এর তোড় তোমাদের থেকে মানে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জন্ম, তাদের থেকে আমরা বেশি বুঝতে পারি, যখন এর বিপরীতে ছিলাম। গত শতকে যখন আমার জন্ম, তখন কী ছিলো না, আর কল্পনারও অধিক আমরা এখন যে সব সুযোগ-সুবিধায় ভাসছি। অতএব বদলানো প্রেক্ষাপটের গতি এবং প্রযুক্তির অবদান আমরা মানে সৃষ্টিশীল মানুষেরা যেন বৃহত্তর স্বার্থে এর কল্যাণকর দিকটিকে প্রতিভাত করি।
শফিক হাসান : গল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
দীলতাজ রহমান : প্রযুক্তির যত কিছুই আমাদের বাড়তি যোগান দিক, গল্প গল্পের জায়গায়ই থাকবে। সময়ের প্রয়োজনে নাটক সিনেমার চাহিদা বেড়ে গেছে। আর নাটক সিনেমা করতে গেলেও গল্প প্রয়োজন। আর সরাসরি সাহিত্য পাঠের মানুষ, তুলনামূলকভাবে না বাড়লেও বেড়েছে। সেটা বইমেলার দিকে আলোকপাত করলে বোঝা যায়।
শফিক হাসান : বিশ্বসাহিত্যে বাংলা গল্পের অবস্থান কোথায়?
দীলতাজ রহমান : আমাদের গল্পের শুরুই একটি সমৃদ্ধ জায়গা থেকে। আমাদের লেখা অনেক গল্প বিশ^মানের। এর ভেতর আরো অনেক তরুণ এগিয়ে আসছেন ভালো একেকটা শুরু নিয়ে।
শফিক হাসান : আপনার গল্প লেখার প্রেরণা কী?
দীলতাজ রহমান : প্রেরণা এবং সহযোগিতা দুটো বিষয় যদি মিলিয়ে না ফেলি, এই ব্যবধান নির্ণয় করতে গিয়েই দেখি আরেক গল্প তৈরি হয়ে যাবে। লেখা হয়ে গেলে, পাঠকের খারাপ লাগবে না সে গল্প। কিন্তু সাক্ষাৎকারগ্রহীতা হিসেবে তোমার ধৈর্য থাকবে তো?
শফিক হাসান : থাকবে, বলেন।
দীলতাজ রহমান : আমার মায়ের ছেলে ছিলো না। মা সব সময় খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। বাবা ছিলেন, জমিদারদৌহিত্র এবং বাউণ্ডুলে। কিন্তু আমার বাবা উঁচুস্তরের একজন দার্শনিকও ছিলেন। বাবার বিষয়-সম্পত্তির ওপর কোনো টান ছিলো না। তাই তাঁর শিষ্যদের ভেতর থেকে সবচেয়ে ধীমান যুবকটির ওপর আমার মায়ের নজর পড়ে। বাবাকে মা বললেন, তার সেই শিষ্যটির সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিতে। বিয়ে হয়ে গেলো। কিন্তু তিনি বারো বছর অগে এমএ পাশ করেছেন, আর আমি মাত্র নাইনে পড়ি! তো দুই পক্ষেরই প্রবল ইচ্ছে আমি লেখাপড়া করে স্বামীর যোগ্য স্ত্রী হই। কিন্তু আমি অংক পারতাম না। কোনো বিষয়ই আসলে ভালো পারতাম না। কারণ, বাউণ্ডুলে বাবা যখন তখন এক জায়গা ছেড়ে আরেক জাযগায় খেয়ালখুশি মতো স্থানান্তরিত হয়েছেন। তিনি একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকও ছিলেন। প্রচুর টাকাপয়সার সমাগম ছিলো। তবু আমাদের দারিদ্র্য সারেনি অব্যবস্থাপনার জন্য।
লেখাপড়া বলতে আব্বা বুঝতেন, তার জন্য স্কুল লাগে না। নিজে স্বশিক্ষিত হলেও তিনটি ভাষার উপর তাঁর প্রচণ্ড দখল ছিলো। ইংরেজি, বাংলা, উর্দু। আমাদের গোপালগঞ্জ শহরের কাছে নদীর কূলে ভেড়ারহাট নামে একটি বিখ্যাত জায়গা আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী এক হাটবারে পুরো হাটটি ঘিরে ফেলে। সবাইকে খতম করে দিতে। তখন সবাই আমার আব্বাকে খুঁজে বের করে তাদের মোকাবেলা করে। আমার আব্বার কণ্ঠস্বর মাইক ছাড়াও বহুদূর যেতো। তারপর তখন সেই একহাট মানুষের ঘোর কেয়ামতের সময় আমার বাবা অবতারের ভূমিকা পালন করেছিলেন।
আমরা কোথাও যেতে পারতাম না। মনে হতো, মুরগির বাচ্চা ফুটলে তাকে শুধু পলো নয় উপরে আবার একটা ছালা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় যেন কাক-চিল ছোঁ না মারে। আমাদেরকে আব্বার শাসনের ধরনটা ওই রকম ছিলো।
শফিক হাসান : তারপর লেখাপড়ার কী হলো?
দীলতাজ রহমান : তো ওইভাবে বাংলায় ঝরঝর করে সব পড়তে পারি। কিন্তু অন্য কোনো সাবজেক্টের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। আমি যদি জানতাম যে আমি মেট্রিক পাশ করবো, তাহলে হয়তো বিয়েতে কবুল নাও বলতে পারতাম! স্কুলে ভর্তি হওয়ার একটা কারণ ঘটে গেলো। আমার বড় বোনের বিয়ে হলে (সৎবোন অবশ্য) তার দেবরের নজর পড়লো আমার ওপর। তখন আমি সিক্সে পড়ি। সিক্সের অর্ধেক বছর অবশ্য স্কুলে গেছি। কিন্তু ক্লাস সেভেনের বই আমার দেখা হয়নি। তো বোনের দেবর বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারতো না বলে, হরহামেশা মোটর সাইকেল নিয়ে বাড়ির আশপাশে ঘুম ছাড়া বাকি সময় ঘুরঘুর করতো। এতে বিষয়টা যখন আশপাশে চাউর হয়ে গেলো, আমার বাবা টের পেলেন তখনি। বাবা বললেন, আমি একবাড়িতে দুই মেয়ে বিয়ে বিয়ে দেবো না। এভাবে চলতে থাকলো আরো আরো দু’বছর। কিন্তু বাবা যখন টের পেলেন, তাঁর বড় মেয়ের দেবরের উড়ে আসা কোনো চিঠিই আর নিরুত্তর থাকছে না, তখনই আরেক মেয়েকে সেই ঘোর কাটিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলতে ক্লাস নাইনের একসেট বই কিনে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।
শফিক হাসান : ইন্টারেস্টিং!
দীলতাজ রহমান : আব্বা একাডেমিক শিক্ষা নিয়ে খামখেয়ালী আচরণ করেছেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখাতেন বড় বড়। আমি একটু বড় হয়ে যখন গ্রামে গিয়ে ছেলেদের সাথে প্রতিযোগিতা করে ফার্স্ট হতাম, একদিন তা দেখে ফেলে, আনন্দে বলে ফেললেন, ওকে আমি মিলিটারিতে ভর্তি করে দেবো। কিন্তু মিলিটারিতে তো মেয়েরা নিয়োগ পাচ্ছে এই সেদিন থেকে।
আব্বা বছর হিসেব করে দুই-চার সেট ক্লাসের বই দু’তিনবার কিনে দিয়েছেন। কিন্তু সেখান থেকে বাড়িতে বসে বাংলা ছাড়া কিছুই পড়া হতো না! ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়ে তো আমার খাবিখাওয়া দশা! টেস্ট পরীক্ষাটি দিয়েছিলাম। তার পরপরই বিয়ে। জানতেও যাইনি পাশ না ফেল করেছিলাম।
শফিক হাসান : আপনার বোনের দেবরের কী হলো?
দীলতাজ রহমান : আমার তখন শ্যাম রাখি না কূল রাখি দশা। আব্বা ছিলেন বাঘের মতো ভয়ঙ্কর! বিষয়টি আমার তরফ থেকে বাড়াবাড়ি করার উপায় ছিলো না। ঘটনাটি টঙ্গিতে। তারপর বিয়ের বিশদিন পর আমরা ঢাকায় চলে আসি। তখন একটা নিম্নবিত্ত পরিবারে টেলিফোনের বিলাসিতাও কল্পনার বাইরে ছিলো। তাই ওটা ছাইচাপা আগুন হয়েই ছিলো অনেক বছর...।
শফিক হাসান : লেখালেখিতে এসব ঘটনার প্রভাব পড়েছিলো?
দীলতাজ রহমান : জীবনযাপনে তার কোনো প্রভাব পড়তে না দিলেও লেখালেখির ভেতর যে তার রেশ বয়ে যায়নি তা নয়! স্বীকার করে যাওয়াটাই আমি সঙ্গত মনে করি। আরো সঙ্গত মনে করি এজন্য, যে সে তো কোনোদিন আমার সামনে এসে দাঁড়ায়নি! আমাকে আমার মতোই থাকতে দিয়েছে। বরং আমি তার মৃত্যুর খবরটি ঠিক একযুগ পরে জেনেছি। তবে, আরো একটু ক্ষীণ সন্দেহ আমার আছে, আমার সাথে পড়তো, মানে নাইনে ভর্তি হয়ে ওকে আমি পাই ক্লাসে। সে আমার প্রতি কেন যেন ওকে প্রতিদিন এটাওটা বলে বিষিয়ে তুলতো। আর একটু ঝিম মেরে গিয়েছিলো তাতে আমার মনে হয়। ওইটুকু বয়সে ঘটনাটি আমাকে খুব অসহায় করে ফেলেছিলো। পরিবার চাইতো না। আবার আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবীও চাইতো না, যে বিয়েটি হোক। তাই সে চাইতো আমি যেন আমার ওই বান্ধবীর থেকে দূরে থাকি। বিষয় এটুকুই। কিন্তু আমার সেই বয়সেই আমি আমার প্রতি এতটুকু অবহেলারও বোধহয় প্রতিশোধ নিয়ে ফেলেছিলাম।
শফিক হাসান : লেখালেখিতে আপনি প্রেরণা ও সহযোগিতার বিভাজনের কথা বলতে চেয়েছিলেন...।
দীলতাজ রহমান : আমার হাজব্যান্ড যখন বললেন, ইদানীং তুমি যা লিখছো, কবিতা! এই যে কথাটিতে তিনি আমার নিজের মুখোমুখি করে দিলেন। মানে আমার নিজের লেখক সত্তাটির সাথে তিনিই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
শফিক হাসান : আপনার তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যেমন নেই বললেই চলে। আবার প্রচুর ভালো বই পড়েছেন, সেরকমও তো বললেন না! লেখালেখিতে আপনার নিজস্ব একটি ভাষা তৈরি হয়ে গেছে বলার চেয়ে স্বীকার করতে হয়, শুরু থেকেই আপনার ভাষা, গল্পের গাঁথুনি একেবারে ভিন্নতর। নিচু ক্লাসের দুইতিনটি বাংলা বই পড়ে এটা সম্ভব হলো কীভাবে!
দীলতাজ রহমান : জীবন আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছে তাই আমি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমার বয়স নয় বছর। আমার অতি শৈশব কেটেছে খুলনায়। যুদ্ধের তিনমাস আগে মাত্র আমরা ঢাকায় এসেছিলাম। তারপর একদিন বাবা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমার মাকে বললেন, কোনো স্বাধীনতাই রক্তপাত ছাড়া আসে না। আর ঢাকা তো রাজধানী। এখনি বাড়িতে চলে যাই। বলে আমার মনে আছে, তাড়াতাড়ি করে কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে তক্ষনি আমরা গোপালগঞ্জে চলে গেলাম। সেবার বাড়ি গিয়ে আমি আমাদের ঘরের মাচায় উঠে গেলাম সবার নজর বাঁচিয়ে। একটা কোলা দেখলাম ঢাকনা দিয়ে ঢেকে আবার কাদামাটিতে মুখ লেপা। আমার ভারী কৌতূহল হলো কী এমন জিনিস এর ভেতর সংরক্ষিত! একটা খুন্তি দিয়ে মৃদু চাপ দিতেই পুরো লেপটা আলগা হয়ে গেলো। আমি কিছু চিড়া-মুড়ির আশায় ভেতরে হাত ঢোকাতেই বুঝতে পারি কাগজপত্র। একথাবা তুলতেই দেখি, আমার মায়ের চিঠি, আমার বাবাকে লেখা! আমার মা অত্যন্ত শিল্পিতি রুচির একজন মানুষ ছিলেন। গ্রাম-শহর যেখানেই থেকেছি দেখেছি আমার মাকে দিয়ে একখানা চিঠি লিখিয়ে নেওয়ার জন্য সব ধরনের মানুষ কী রকম ধর্ণা দিতেন। তারপর মা যেদিন সময় করে উঠতে পারতেন, লেখার সময় মাকে চিঠির প্রেরক ছাড়াও ঘিরে থাকতেন আরো মানুষ। তারপর সে চিঠি ঘুরে ঘুরে সারাবাড়ির নাকের জল চোখের জল এক করে পোস্ট হতে হতে চিঠির সেখানেই ন্যাতা ন্যাতা দশা!
তারপর কাউকে ইনজেকশন দিতে হবে, ডাক পড়তো আমার মায়ের। রুমালে ফুলতোলা, ডালপালা, ফুলপাতা কোনটার কী রঙ হবে, মাকে দেখতাম বিভিন্ন রঙের সুতো রেখে রেখে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ঝি-বউদের।
আমার মায়ের স্বাতন্ত্র্যবোধ তীব্র ছিলো। আমার লেখালেখির ছিঁটেফোটা প্রকাশ আমার মা দেখে গেছেন। তাতেই, আমি জানি না কোন লেখকের মা তাঁকে- লেখককে বলার ক্ষমতা রেখেছেন, তোমাকে রবীন্দ্রনাথের মতো ভালো লিখতে হবে না। তোমাকে তোমার মতো লিখতে হবে। লেখার উপরে তোমার নাম না থাকলেও যেন পাঠক বুঝতে পারেন, লেখাটি তোমার!
শফিক হাসান : আপনার মায়ের চিঠির প্রসঙ্গ তুলেছিলেন...।
দীলতাজ রহমান : বলি আরেকটু! হুবহু কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে তো! মা বলেছেন, তুমি যখন চাল ঝাড়বে কুলোর টোকা শুনে যেন মানুষ বুঝতে পারে তুমি চাল ঝাড়ছো! একটি কাঁথার ভেতরে চার ইঞ্চি সেলাই যদি তোমার হয়, মানুষ তাও যেন চিহ্নিত করতে পারে।
শফিক হাসান : বিষয়টা প্রায় অসম্ভব না?
দীলতাজ রহমান : শোনো, আমার মায়ের কথা, মানুষ তার সৃষ্টির ভেতর বেঁচে থাকে। এই প্রবাদের সম্মান রক্ষার্থে বলছি, আমার মা তাঁর স্বকীয়তার উৎস বোঝাতে কী অজ্ঞাত, অখ্যাত ছিন্নমূল নারীদের নামও উল্লেখ করতে কুণ্ঠিত হননি। বলেছেন, আমি চাল ঝাড়তে নূরজাহানের মাকে অনুকরণ করেছি, কাঁথা সেলাইয়ে শফির মাকে, চুলো বানাতে আনারের মাকে!
চিঠির কথা জানতে চেয়েছিলে। তারপর নিষিদ্ধ উত্তেজনায় মনটা কেমন কেঁপে উঠলো সেই তখনি! আমি একমুঠো চিঠি ফ্রকের আড়ালে করে নিয়ে বাড়ির শেষ সীমানা একটি খড়ের পালার আড়ালে চলে গেলাম। তখন আমার কাজই হয়ে গেলো, সবার নজর বাঁচিয়ে ওই জায়গাটিতে গিয়ে চিঠি পড়া। আমার মায়ের আগে আমার বাবা আরেকটি বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু কথা ছিলো সে স্ত্রীকে আর আনা হবে না। কারণটি বহুবিধ। কিন্তু একটি সময় আমার মায়ের নির্বোধ অথবা মহৎ অনুগ্রহে তিনি আমার বাবার সংসারে থেকে যেতে পারেন। চিঠিতে সেই সময়কার যে ত্রিমুখী দ্বিধাদ্বন্দ্বের ক্ষতবিক্ষত অবস্থা ফুটে উঠেছিলো। কী বলবো, আমার গায়ে কাঁটা দেয় এখনো। আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো?
আমার মনে হয়, আমার তো লেখক হওয়ার কথা ছিলো না! প্রায়ই মানুষ দু’জনে মিলে একটি সন্তান সুস্থভাবে বড় করে, বিদ্বান করে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। সেখানে প্রায় আমি একা চারটি ছেলেমেয়ে নিজে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছি। সেটাও আল্লাহ্ তৌফিক দিয়েছিলেন বলে পেরেছি। কিন্তু এই যে আমি অকর্ষিত এক মস্তিষ্ক নিয়ে যে সাহিত্য রচনা করি, সেটা আমার মায়ের সেই ত্যাগেরই ফসল! আর সেই তখন যদি আমি ওই চিঠিগুলো না পড়তাম। অসম্ভব ছিলো এধরনের লেখা!
শফিক হাসান : তাই তো মনে হচ্ছে!
দীলতাজ রহমান : আমার লেখা যদি সাহিত্য হয় তাহলে মায়ের জীবনযাপনের ধরন এবং সেই চিঠিসমূহেরই আঁচে ফোটা বিন্দু বিন্দু খই ছিলো সেগুলো! পড়া চিঠিগুলোও ওই কোলার ভেতর ছেড়ে দিতাম। তারপর দেখতাম একমুঠোতে দশখানা চিঠির হয়তো পাঁচখানা আগে পড়া। তারপর পড়া চিঠির সংখ্যা বাড়তে থাকায়, একদিন খুব সাবধানে চুলার কাছ থেকে খেটোনি (মানে যে লাঠিটি দিয়ে চুলোর আগুন খুঁচিয়ে, উস্কে দেওয়া হয়) এনে যথাসাধ্য চেষ্টায় ওলটপালট করে নিলাম। তারপর চিঠি পড়তে মগ্ন সময়ে আমার এক ডাগর হয়ে ওঠা চাচা আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে তার কী সন্দেহ হলো। তিনি আমার মায়ের অতি চেনা হাতের লেখা দেখে আমার ঘাড় ধরে আমার মায়ের সামনে নিয়ে হাজির করলেন। মাকে বললেন, ‘দ্যাহো মাইয়া তোমার আর ভাই-র প্রেমের চিঠি ফড়তিছে!’ আর এইটুকুতে আমার দুই মা আর বাবার সামনে বোধহয় তাদের বিশ বছর আগের রুমালে বাঁধা কোনো ধূপ-বারুদে মিশেল কোনো স্মৃতির বিস্ফোরণ ঘটেছে। পুরো বাড়ি থমথম...। দু’চার ঘা মার যে পিঠে পড়েছিলো, তা বেশ মনে আছে! মাঝে মাঝে একটা কথা মনে করে আমি একাই হেসে ফেলি! সেদিন যদি ওই কোলার ভেতর চিঠি না থেকে মচমচে চিড়া-মুড়ি থাকতো, আজকে কী হতাম! হয়তো ছেলেমেয়েদের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া চালিয়ে আমলাও হয়ে যেতাম। কারণ লেখাপড়া করলে সে বিদ্যে কাজে লাগানোর গরজ অন্তত আমাকে ছাড়তো না!
শফিক হাসান : আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশের নেপথ্য গল্প কী?
দীলতাজ রহমান : প্রায় একযুগ ধরে আমি তেমন লিখি না। সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করার কথাই বলি বরং। আমার অফিসে বেতনভুক্ত ছেলেগুলো আমার সাতটি বই যোগাড় করে কম্পোজ করেছে। ‘গল্পসমগ্র ১’ করার সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে। তারপর ডিসেম্বরের বিশ তারিখ রাতে ঢাকায় ফিরেই হামলে পড়লাম বইটি নিয়ে।
শফিক হাসান : আপনার প্রিয় গল্পকার কারা, কেন প্রিয়?
দীলতাজ রহমান : কোনোকিছু প্রিয় করে তুলতেও অধ্যবসায়ের দরকার। আমার জীবনে সেরকম অবকাশ ঘটেনি। আমার লেখাপড়া করার অভ্যাস কিছুটা আছে। কিন্তু জীবনের শুরুতেই শুধু নয় আগেই সংসারের জোয়ালটি আমার কাঁধে চেপে যায়। আমি নিজে লেখাপড়াই ছেড়ে দিলাম সন্তানদের লেখাপড়া করাতে। তবে আমার জীবন পাঠের তৃষ্ণা আছে। প্রকৃতি আমার মূল পাঠের আসল বিষয়।
শফিক হাসান : বাবা-মা, স্বামীর কথা বললেন। ছেলেমেয়েদের কথা বলবেন না?
দীলতাজ রহমান : ব্যতিক্রমভাবেই আমার ছেলেমেয়েদের গড়ে তুলতে চেয়েছি। সবাই অবশ্য তাই করতে চায়। আমার বড় ছেলে আশিক লেখাপড়া করেছে আমেরিকায়। ও সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ। অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল। ওর ওয়াইফ ইফা রুশদী। ইফা ছোটবেলা থেকে অস্ট্রেলিয়ায়। ও ইকোনমিস্ট, অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি চাকরি করে।
তারপর আমার মেয়ে ফারহানা রহমান। ফারহানা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বুয়েট থেকে পাশ করে বুয়েটে টিচার হিসেবে বছরখানেক ছিলো। তারপর অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটি থেকে সরাসরি পিএইচডি করেছে। ফারহানার হাজব্যান্ড মাহফুজ চৌধুরী। সে বুয়েটে ফারহানার ক্লাসমেট ছিলো। মাহফুজ জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছে। এখন ওরা অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল।
তারপর আমার মেয়ে আরেক ফারজানা, ও বাংলাদেশে আছে। একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ওর হাজবেন্ড ল’ইয়ার। সবার ছোট, ছেলে আরিফ। ও নিউজিল্যান্ডের ওটাগো ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলো স্কলারশিপ নিয়ে। তিনমাস থেকে চলে আসে। আমাদের একটা সফটওয়্যার ফার্ম আছে। ও সেটার দেখভাল করছে। বিট মাস্কট, আমি এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। আরিফ ওই অফিসের টানে থাকতে পারেনি। বলেছিলো, ‘ওরা আমাকে যা পড়াবে আমি তা পারি।’ এই হলো মোটামুটি আমার জীবনের গল্প। আর হ্যাঁ, আমার হাজব্যান্ড এ. কে. ফজলুর রহমান সোনালী ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন।
0 Comments