Advertisement

উন্মেষ

মিতালী ফুকন-এর গল্প : হুদুম দেও | অনুবাদ : বাসুদেব দাস

weeklyunmesh golpo onubad

বীরবালা প্রত্যেকের অনুরোধে একটা কলাগাছ কেটে আনল। অমাবস্যার অন্ধকারে সম্পূর্ণ বস্ত্রহীনভাবে নিয়মমতো গাছটা আনতে কোনো খুঁত রাখেনি। ‘এক কুশিয়া ছাওয়া’ গ্রামটিতে বীরবালা ছাড়া আর কেউ নেই। ‘ইষ্টদেবতা’রূপে পূজা করা গাছটা এনে নদীর পাশে লোকালয়হীন নির্জন ঘাটের তীরে রোপণ করতে লাগল। গোটা গ্রামের মহিলারা দলে দলে এসে জমায়েত হল।

জানকী পুজোর সামগ্রীসমূহ একে একে মাটিতে নামিয়ে রাখল। ষোলোটি কলা থাকা এক কাঁদি জাহাজী কলা, ঘি, দুধ, চিনি, কিছুটা আতপ চাল, ফল—সিনেমা হলের কাছে গ্রাহকের খোঁজে ঘুরে বেড়ানো মণিকংকনা খ্যাত দুটি মহিলাও দৌড়ে এসেছে। ওদের দেখে দুজন ‘ইস-উস’ করল। ওরা এসে যেন বিঘ্ন ঘটাল। বীরবালা ঘৃণায় ভরা চোখগুলির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল—
“এই পুজোতে তাদেরও ভূমিকা আছে। আমি ওদের ডেকে এনেছি।”

মণি নামের দেহোপজীবিনী মেয়েটি বীরবালার হাতে একটা পুঁটুলি দিল। বীরবালা পুঁটুলিটা খুলে মাটির একটা ডেলা বের করল। সঙ্গে একটা দাঁড়কাকের মাথা, একটা পেঁচার বাসা। কংকনা চাদরের আঁচলে বেঁধে আনা কয়েকটি কেশ দিয়ে বলল— “বড়োমা, অনেক খুঁজে খুঁজে এনেছি। সাতজন সধবাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পুজোর জন্য কষ্ট করে খুঁজে এনেছি।”

বীরবালা ভালো করে জানে মণিকংকনা এনে দেওয়া জিনিসগুলি অন্য কেউ আনতে পারবে না এবং সেই জিনিসগুলি আনা না হলে পুজো অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাই ওদের স্পর্শ করলে অন্যদিন তিনবার স্নান করলেও সে কথা মনে পড়ল না। দুজন মহিলা কলাগাছটা লাগানোর জন্য একটা গর্ত খুঁড়তে লাগল। বীরবালা তার মধ্যে পেঁচার বাসাটা এবং মণিকংকনা আনা জিনিসগুলি ঢেলে দিল। গ্রামটিতে ‘এক কুশিয়া ছাওয়া’ বীরবালাই আছে। তাই সেই প্রধান পূজারিণী। গর্তটার ওপরে একটা টুকড়িতে দাঁড়িয়ে সে স্নান করতে লাগল। এক বস্ত্রহীন বীরবালাকে দুজন মহিলা ফুল-তেঁতুল দিয়ে কলসে রাখা জল দিয়ে স্নান করাল। শঙ্খ, উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে পড়ল নদীতীরের মাঠটা। বীরবালা দুচোখ বুজে বিড়বিড় করল— “দেবরাজ, যেইনা ঘাটে দুর্বা-তুলসী ভাসে, যেইনা ঘাটে ঢাকের বাজনা বাজে—সেইনা ঘাটে নাও মোর পূজা, দেবরাজ।”

কোনো এক শিহরণে বীরবালার আড়াই-কুড়ি বছরের শরীরটা কেঁপে উঠল। বহু বহু বছর পরে এরকম একটি ঠান্ডা শিহরণ। শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে স্পর্শ করে গেছে। বন্ধ থাকা চোখদুটি খুলে বীরবালা স্তব্ধ হল। একটি কল্পনাবিহীন ছবি এটি—সম্পূর্ণ নিরাভরণ একদল মহিলা মুক্ত আকাশের নিচে। কাপড়ে শরীরের অঙ্গ ঢেকে ফর্সা লজ্জাশীলা সেই নতুন বধূ কয়েকজনও সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নেই কোনো সংকোচ, নেই কোনো লজ্জা…

বীরবালা সচকিত হল—পুজোর নামে এই সমস্ত মহিলা আদিমতার রূপ লাভ করে নি তো? এটা তো বীভৎস দৃশ্য। সত্যিই পুজো করতে এসে সভ্যতার ইতিহাসে আরও দু’পা পিছিয়ে যায় নি তো? বীরবালা বিমূঢ় হয়ে পড়ল। কাকে প্রথম স্থান দেবে—বিজ্ঞানকে, না লোকবিশ্বাসকে? লোকবিশ্বাসের নামে এই সমস্ত নারীরা ব্যভিচার করছে না তো? আমাদের গ্রামের প্রতিটি পরিবার সমাজের রীতিনীতি মেনে নিজেদের পরম্পরা রক্ষা করে আজ পর্যন্ত অতীতের পূর্বপুরুষদের সহজ জীবনপ্রণালী মেনে এসেছে। সবই তো দেখছি ঠিকঠাক চলছে। নেই কোনো অসূয়া-অপ্রীতি। আজ পর্যন্ত গ্রামে কোনো হত্যা-লুণ্ঠন, ডাকাতি ইত্যাদি ঘটনা ঘটেনি। খবরের কাগজ, ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে এক্সক্লুসিভ নিউজ করতে হয়নি।

বীরবালার মতে অতীতের নীতি-নিয়ম মতো এই ধরনের একটি শান্তিময় পরিবেশ গ্রামে বজায় রয়েছে। নীতি-নিয়মের সঙ্গে একতা, ভ্রাতৃত্ববোধ গ্রামটির প্রতিটি পরিবারেই আছে। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে প্রত্যেকেই পরস্পরকে সঙ্গ দান করে। বীরবালা তাই প্রত্যেককে বলে—ছেলে-মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হলেও পরম্পরাটা ধরে রাখতে শেখানো উচিত। সমাজে যতই উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে ততই পরম্পরাকে পুরোনো দিনের রীতি-নীতি বলে পায়ে মাড়িয়ে গুরুজনদের অবজ্ঞা করা প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের বড়ো বলে ভাবাটা অন্য কারও কথায় গুরুত্ব না দেওয়ার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেইজন্যই আজকাল পরিবারে পারিবারিক নির্যাতন, শাশুড়ি-বৌমার মধ্যে মতানৈক্য বেড়েছে। একটা ছোটো কথা থেকে অনেক বড়ো হুলুস্থুল শুরু হয়ে যায়…

“চানামা, কলাগাছটা গর্তের মধ্যে রোপণ করে দিন…”
ভাইপো-বৌয়ের ডাকে বীরবালা চমকে উঠল।

কলাগাছটা ধুয়ে চারজন মহিলা ধরে এনে বীরবালার সামনে দাঁড়াল। একজোড়া পান-সুপারি এবং বারো ধরনের শস্য রাখা জলে পরিপূর্ণ ঘটটা অন্য একজন মহিলা ধরে আনল। বীরবালা কলাগাছটা দুজন মহিলার সাহায্যে গর্তটায় পুঁতে দিল। একজন মহিলা সঙ্গে সঙ্গে গাছটির গোড়ায় মাটি চাপিয়ে পুজোর জায়গাটা মুছে ফেলল। ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে জায়গাটা এমন করে মুছল যে জায়গাটা মাঠ না বলে উঠোন মনে হতে লাগল। জলে ভরা ঘটটা এনে কলাগাছের গোড়ায় বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আয়োতিরা উলুধ্বনি দিয়ে পরিবেশটা মুখরিত করে তুলল। মুহূর্তের মধ্যে সর্ষের তেলের প্রদীপ, ধূপ আর ধুনোর গন্ধে জায়গাটা পরিপূর্ণ হয়ে গেল। মাঠ নয়—যেন নদীর তীরে একটা মন্দির গড়ে উঠল।

এই অঞ্চলে বহুদিন ধরে বৃষ্টি হয়নি। ধুলো আর মাকড়সার জালে ভরে উঠেছে এলাকাটা। খরা শুধুমাত্র খরা। গাছগুলির হলদে হয়ে যাওয়া পাতাগুলি খসে পড়ে জীর্ণশীর্ণ অবস্থা। নতুন পাতা গজায়নি। ঘাস-বন শুকিয়ে যাওয়ার জন্য গরু-ছাগল জীবজন্তুর অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে।

কিছুদিন থেকেই গ্রামটিতে মহামারী—কলেরা, বসন্তরোগের প্রাদুর্ভাব জনগণকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আবহাওয়া-পরিবেশ মানুষের মনও খরা করে তুলেছে। পুকুর, এমনকি গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটিও শুকিয়ে গেছে। চারপাশে জলের জন্য হাহাকার। শুধু বীরবালাদের গ্রামেই নয়। খবরের কাগজে অনেক জায়গায় বৃষ্টি নামানোর জন্য ‘বরুণ দেবতা’র নামে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এই গ্রামেও ব্যাঙের বিয়ে পাতার কথা বীরবালার মনে আছে। বীরবালার মা এই আয়োজনে অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। বীরবালার মা সুন্দরভাবে ‘বিয়া-নাম’ গাইতে পারত। আজও বীরবালার কানে মায়ের সেই কণ্ঠস্বর বাজে—

“বুড়ো মেঘ দেবতা বৃষ্টি দাও,
ব্যাঙের পেতেছি বিয়া।
বরুণ দেবতা বর্ষিত হোক,
বয়ে যাক মাঠের আলপথ…”

বীরবালা দেখে আশ্চর্য হয়েছিল—মা ব্যাঙের বিয়েতে ভক্তিভরে নাম গান করার পরে অঝোরধারে বৃষ্টি নেমে আসায় কাপড় ভিজিয়ে ঘরে ঢুকত। সেদিনটা মা উপোস করত। মুখে এক ফোঁটা জল দিত না। কখনও কখনও বীরবালার মনে হত—মা ভক্তিভরে বরুণ দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য ব্যাঙের বিয়েতে গান গাইত বলেই বৃষ্টি নেমে আসত।

এখনকার প্রজন্ম তো এই ঘটনাকে এক মুহূর্তে অলৌকিক বলে নস্যাৎ করবে। কিন্তু সাধনা—সাধনার বলে যে একজন মৃত্যুমুখী মানুষও সঞ্জীবনী সুধা লাভ করতে পারে—সে কথাটা মিথ্যা নয়। সাধনাই তো মানুষকে ঐশ্বরিক শক্তি দান করে। সেই শক্তির দ্বারা মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। তা না হলে তানসেন মেঘমল্লার রাগের সাহায্যে বৃষ্টি নামাতে পারত! এটাই তো সাধনা—সাধনার কাছে কখনও বিজ্ঞানও হার মানে।

চিকিৎসক মৃত্যুর সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরেও মৃত্যুমুখী রোগী তো যোগাভ্যাসের মাধ্যমে নতুন জীবন পাওয়ার মতো আশ্চর্যকর ঘটনাও এই পৃথিবীতে ঘটেছে। বীরবালা সংস্কারমুখী নারী হলেও আধ্যাত্মিকতা বিশ্বাস করে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করে। বীরবালা জানে—মানুষের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ায় এবং সুনামি, খরা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিরন্তর ঘটে চলেছে।

“বড়োমা, বড়োমা, পুজোর কাজ হয়ে গেছে। আপনার কাজ আরম্ভ করুন…”

সমস্ত মহিলাদের মধ্যে বীরবালাই বয়োজ্যেষ্ঠা। কেউ ভাইয়ের বউ, কেউ ভাগ্নে-বউ, কেউ ভাইপোর বউ, কারও মাসি, পিসি, সম্বন্ধের দিদি। অন্যান্য দিন জ্যেষ্ঠা হিসেবে বীরবালার কাছে ঘোমটা টেনে সাত হাত দূরে থাকে—যদিও আজ একেবারে পাশে। আজ যেন একই আকাশের নিচে, একই মাঠে, একই পুজোর স্থানে সমস্ত মহিলারা একত্রিত হয়ে পড়েছে। কোনো ধরনের উচ্চনীচ, ছোটো-বড়ো, ধনী-গরিব ভাব নেই। প্রত্যেকেই এই মুহূর্তে মনে প্রাণে এক।

জন্মের মুহূর্ত এবং মৃত্যুর পরে চিতায় উঠানোর সময় যেমন বস্ত্রহীন হয়ে সবার পরিচয় একাকার হয়ে যায়, এই মুহূর্তেও প্রত্যেকের পরিচয় একই—বস্ত্রহীন এক ঝাঁক স্ত্রীলোক। সামনে ইষ্টদেবতা ‘হুদুম দেও’। আদিম উর্বর দাতা এই দেবতা শুধুমাত্র মহিলাদের। কোনো পুরুষ বা কুমারী মেয়ের ক্ষেত্রে ‘হুদুম দেও’ দেবতা হতে পারে না।

বীরবালা মাটির প্রদীপের আলোতে মুখগুলি এক পাশে থেকে দেখে গেল। প্রতিটি মুখই পরিচিত। গ্রামের দুটি মেয়েও এসেছে। দুজন বিধবাও রয়েছে। অনেক বছর ধরে এই পুজো হচ্ছে। তাই প্রত্যেকের উৎকণ্ঠা, কৌতূহল।

বীরবালা আর অপেক্ষা করল না। রাত দুপুর হয়ে গেছে; তার মধ্যে অমাবস্যা—পরিবেশ নির্জন ও ভয়ংকর। বীরবালার মনে একট শঙ্কা আছে—এত বড়ো পুজোর আয়োজন করে যদি মনস্কামনা সফল না হয় তাহলে কী হবে! অন্যেরা না হলেও নিজের পুত্র-স্বামী হাসাহাসি করবে। না, বীরবালা হাসির পাত্র হতে পারবে না। ধ্যান-সাধনায় ‘হুদুম দেও’ দেবতাকে সন্তুষ্ট করতেই হবে।

বীরবালা রোপণ করা কলাগাছটা জড়িয়ে ধরল। আদিরসাত্মক ভঙ্গিমায় বীরবালা কলাগাছটা এভাবে জড়িয়ে ধরল যে সেই কলাগাছ যেন একটি পুরুষে রূপান্তরিত হল।

সমস্ত শরীরে ব্যাখ্যাহীন এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে গেল। আড়াই-কুড়ি বছরের শরীরে ষোড়শী যুবতীর মতো চঞ্চলতা নেমে এল। বীরবালাকে দেখে একজন একজন করে স্ত্রীলোক জড়িয়ে ধরল। বীরবালা গেয়ে চলল—

“জাগো রে জাগো রে হুদুম দেও,
আজ কার রাত।
গৃহস্থ করে পূজা, ধূপ জ্বালান, প্রদীপ জ্বালান,
আশা করে কর পূজা—আকাশ কাওয়ালি…”

বীরবালার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও গাইতে লাগল। সমস্বরে গাওয়া গানের শব্দ মুক্ত মাঠে প্রতিধ্বনিত হল। প্রত্যেকেই ভক্তিভরে গেয়ে চলেছে একের পর এক গীত। এমনকি মণি-কংকনা খ্যাত দুইজন বেশ্যাও প্রাণ ঢেলে গেয়েছে। গান যেন হুদুম দেও দেবতাকে আরাধনা করা মন্ত্রোচ্চারণে পরিণত হল। মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকেরা যেন ষোড়শী যুবতী হয়ে পড়ল। নিজেদের অজান্তেই তারা নৃত্যে মশগুল হল। তাল, ঢোলক, হাততালির শব্দে নির্জন মাঠ যেন উর্বর হয়ে উঠল।

গানের মধ্যে থাকা আদিম প্রজনন সম্পর্কীয় শব্দগুলির উচ্চারণে স্ত্রীলোকেরা কামোদ্দীপক হয়ে উঠল। বীরবালা বিস্মিত—আভরণে ঢাকা এই মহিলারা কীভাবে এত লজ্জাহীন হয়ে উঠল! শাশুড়ি-বউ, মেয়েও—কারও মুখে সংকোচ নেই। প্রত্যেকের মনের গোপনে থাকা আদিম কামনা যেন সমস্ত বাঁধ ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। বয়সের কোনো সীমা নেই। নাচ-গানে প্রত্যেকে হয়ে উঠেছে যৌবনা দীপ্ত ষোড়শী।

এসব কী! বীরবালা নিজেই বীভৎস হয়ে উঠেছে। আড়াই-কুড়ি বছরের শরীরে যোৗবন উঠছে হুদুম দেওর পুজো-গানে! এই গীতে কী শক্তি আছে—যা বহু বছর আগের বন্ধ হয়ে থাকা যৌবনের দরজা খুলে দিয়েছে। বীরবালা শরীরে সেই শিহরণ অনুভব করছে—যে শিহরণ জীবনে প্রথমবার অনুভব করেছিল বিয়ের পরে একজন পুরুষের আলিঙ্গনে।

দ্বিগুণ উৎসাহে বীরবালা বিড়বিড় করে গাইল—

“দেবরাজ যেইনা ঘাটে দুর্বা-তুলসী ভাসে,
যেই না ঘাটে ঢাকের বাজনা বাজে,
সেই ঘাটে নাও আমার পূজা দেবরাজ…”

বাকিরাও দ্বিগুণ উৎসাহে গাইতে লাগল। নাচ-গানের তালে বীরবালার মনে পড়ল ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কথা—কীভাবে ষোড়শী যুবতীরা কামোদ্দীপক নৃত্য-গীত পরিবেশন করে ঋষ্যশৃঙ্গকে অনাবৃষ্টিপীড়িত অঙ্গরাজ্যে নিয়ে এসেছিল। তিনি পা রাখতেই অঝোরধারে বৃষ্টি নেমেছিল।

বীরবালার মনে হল সামনে সে নয়—যেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি! আর তাঁর চারপাশে এক ঝাঁক বস্ত্রহীন মহিলা নৃত্যে-গীতে মশগুল। তাদের রূপ—ঋষ্যশৃঙ্গ যেন সহ্য করতে পারছে না। কীভাবে বন্ধ হবে এই অভীষ্ট সিদ্ধির অভিপ্রায়? ঋষ্যশৃঙ্গের চোখ ধাঁধিয়ে গেল।

এটা কী! আকাশটা দেখছি মেঘে ঢেকে গর্জন করছে। নির্লজ্জ স্ত্রীলোকদের বীভৎস রূপ দেখেই যেন ইষ্টদেবতা সহ্য করতে না পেরে অন্ধকার নামিয়ে এনেছে। বীরবালা জোরে জোরে মন্ত্রোচ্চারণ করল। সে যে আজ এই পুজোর পূজারিণী।

বীরবালা যত জোরে মন্ত্রোচ্চারণ করল, বাকিরাও ততটাই জোরে করল। সমস্বরে উচ্চারিত গীত যেন অন্ধকার ভেদ করে মেঘে আঘাত করল। প্রচণ্ড শব্দে ফুলে উঠল আকাশ। বীরবালা অনুভব করল—আকাশ ফুলে তার কাছে ঋষ্যশৃঙ্গ উপস্থিত হয়েছে। হ্যাঁ—বীরবালা ভিজছে। আয়োতিরা উলুধ্বনিতে বীরবালার শরীরে যেভাবে কলসের জল ঢেলেছিল—সেভাবেই আকাশ থেকে নেমে আসছে জল। খরস্রোতার মতো বয়ে যাচ্ছে সেই জল।

জলের মধ্যে কলকল করে মহিলারা সমস্বরে চিৎকার করল—
“হুদুমদেও… হুদুমদেও…”

লেখক পরিচিতি : সাহিত্য আকাদেমি ভ্রমণ অনুদান এবং অসম প্রকাশন পরিষদের ফেলোশিপ প্রাপ্ত মিতালী ফুকন ছোটগল্প, কবিতা, জীবনীমূলক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি যথাক্রমে- নূপুর পিন্ধা বরষুণ, অস্তিত্ব, আইদেউ, জীবনর রং, লাইপম ইত্যাদি।


Post a Comment

0 Comments