হয়তো পৃথিবীর সব মানুষ প্রায় একই। যদিও পৃথিবী ঘুরে দেখার ভাগ্য আমার হয়নি কখনো। তবে এটা নিয়ে আমার আফসোস নেই। কারণ আমি আমার নিজস্ব পৃথিবী ঘুরে দেখেছি। আমার যতদূর চোখ যায় ততদূরই আমার পৃথিবী। আমার পৃথিবী আমি মন ভরে দেখি। তৃপ্তি নিয়ে দেখি। তীক্ষ্র দৃষ্টি দিয়ে দেখি। মেঠো পথের দু’ধারের দূর্বার ডগায় লেগে থাকা শিশির বিন্দু আমি দেখতে পাই। মাটির হেঁসেলের পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া পিঁপড়াদের আমি খুব মনযোগ দিয়ে দেখি। কি সুন্দর শৃঙ্খলার সাথে দলবদ্ধভাবে তারা এক টুকরো চিনি দানা নিয়ে এগিয়ে যায় পায়ে পা মিলিয়ে। দূরে আনমনে বসে থাকা পাখিটার মন কি বলছে জানতে ইচ্ছে করে। তাকিয়ে থাকি উড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। দেখি, দেখতে আমার ভালো লাগে। আমি যত মানুষ দেখেছি তাদেরকে নিয়েই আমার সব লেখা। তাদের চোখ, নাক, ঠোঁট, গাল, শরীরের প্রায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একই দেখেছি। শুধু চেহারা ও কথার স্বর আলাদা। একেকজনের চেহারা একেকরকম। একেক অঞ্চলের মানুষের কথা বলার স্বর একেকরকম। কিন্তু তাদের চাহনি, ইশারা, ফিসফিস করে কথা বলার ঢং, চেহারায় মন খারাপের ছায়া, আনন্দিত মুখছবি প্রায় সকলের একই। তাদের হেঁটে চলা, দৌড়ে বেড়ানো, ঘাপটি মেরে বসে থাকা, চিত হয়ে শুয়ে থাকা প্রায় একই।
কাজকর্মের ফাঁকে যখনি সময় মিলে ঘরের বাহিরে বেরিয়ে যাই। কোন কারণ ছাড়া এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। ভালো লাগে। এই ভালো লাগা লিখে বা বলে প্রকাশ করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেয়নি। আজ বুধবার। অফিস ছিল হাফ বেলা। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে ভাবলাম বাহিরে বের হবো। আশ্বিন মাস শেষের দিকে। তবুও গড়িয়ে যাওয়া দুপুরের ত্যাজ মোটেও যেন কমেনি। বাহিরে তখনো কড়া রোদ। বেলা তিনটা পঁয়ত্রিশ বাজে। আমি রুম থেকে হামিদপুর বাজারের উদ্দ্যেশে বেরিয়ে গেলাম।
একটা মজার ব্যাপার বলা দরকার। রুম থেকে বের হওয়ার আগে জিন্সের একটা প্যান্ট পরছিলাম। হুট করে প্যান্টের বাম পকেটে হাত দিয়ে দেখি টাকার মতো কাগজ টাইপের কিছু একটা হাতে লাগলো। বের করে দেখি কয়েকটা বিশ টাকার নোট। মানিব্যাগে তিনশ বা সাড়ে তিনশ টাকার মতো ছিল আগে থেকেই। এই টাকাটা যোগ হলো। ভালো লাগলো। হুট করে কোন কারণ ছাড়া টাকা এলে নিশ্চয় ভালো লাগবে। এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে আমার সাথে। খুব সম্ভবত আগস্ট মাসের স্যালারি পাওয়ার পর বুথ থেকে দুই হাজার টাকা তুলেছিলাম হাত খরচের জন্য। রুমে এসে এক হাজার টাকা মানিব্যাগে নিয়েছি আরেক হাজার টাকার একটা নোট ডয়েরে রেখেছিলাম একটা কাগজের নিচে। তারপর অফিসের চাপ, বাসায় রান্না বান্না করা, মায়া আবার গর্ভবতী, আমার একাকীত্ব, বৃদ্ধ বাবা মায়ের চিন্তায় ভুলেই গিয়েছিলাম ডয়েরে রাখা টাকার কথা। প্রায় মাসের শেষের দিকে একদিন কি যেন খুঁজতে ডয়ের খুলেছি। খুলতেই দেখি এক হাজার টাকার একটা নোটের কোনা দেখা যায়। কাগজটা উল্টিয়ে টাকাটা দেখে সে কি আনন্দ আমার। আহা।
হামিদপুর এলাকাটা ফতেহপুর ইউনিয়নের মধ্যে পড়লেও পাশেই যশোর উপজেলা পরিষদ। যশোর মণিহার থেকে হামিদপুর দুই আড়াই কিলো পথ হবে। শহরের এত নিকটস্থ তবুও গ্রামীণ পরিবেশ চারিদিকে। শুধু হামিদপুর না। যশোর শহর থেকে দুই চার বা সর্বোচ্চ ছয় কিলোমিটার পর পরই গ্রামীণ পরিবেশ। যদিও শহরটা বেশ জাঁকজমক বটে। আমার গ্রাম, গ্রামের মানুষ, গ্রামীণ পরিবেশ ভালো লাগে। ভিতরটা শীতল হয়ে আসে। জীবন যেন খুঁজে পায় সজীবতা। কারণ আমি জন্মেছিলাম একদম সবুজ শ্যামলে ঘেরা একটি গ্রামে। আমার বেড়ে উঠা, বড় হওয়া সেখানেই। সেই গ্রামীণ পরিবেশের ছায়ায় নিজেকে মেলে ধরেছি। সেই আমন ধানের সবুজ পাতা, আইলের দূর্বাঘাস। পিচঢালা পথের দু’ধারের ঝাউ গাছ আমাকে খুব করে টানে। তাই সময় পেলেই এদিক সেদিক ছুটে যাই নিজেকে খুঁজতে। নিজের ছেলেবেলাকে দেখতে। নিজের ভিতরটাকে শীতল করতে।
যাহোক, হামিদপুর বাজার থেকে ঠিক দক্ষিণ দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে গ্রামের মধ্যে। একটা ভ্যানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম এই রাস্তা দিয়ে সে কতদূর যাবে? সে জানালো ফুলতলা পর্যন্ত যাবে ভাড়া বিশ টাকা। উঠে পরলাম তার ভ্যানে। এদিকের ভ্যানগুলোয় সিট নেই। সরাসরি বডিতে বসতে হয়। সামনে দুইজন ও পিছনে দুইজন পা ঝুলিয়ে বসতে হয়। ভ্যানের মাঝে ব্যাগ বোঁচকা রাখা যায়। আমি ভাগ্যক্রমে ভ্যানের সামনের বাম পাশে বসেছি। কিন্তু ওরকম পা ঝুলিয়ে আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। মনেহলো শরীরের সমস্ত রক্ত যেন দুই পায়ের পাতায় এসে জমে গেলো। পা দুইটা ভারী লাগছিল। এদিকে শরীরের মধ্যেও অস্বস্তি কাজ করছিল। চাঁনপাড়ায় এসে পিছনের দু’জন যাত্রী নেমে গেলো। সামনে আমার সাথে একজন মধ্যবয়সী মহিলা। তিনিও চাঁনপাড়া পাড় হয়েই নেমে গেলো। এদিকে আমি আর পা ঝুলিয়ে রাখতে পারছিলাম না। ভ্যানওয়ালাকে পা তুলে বসার কথা বলতেই তিনি চুপসে গেলো। মনে হলো তিনি একটু বিরক্ত হলেন। তাই আমি একটা পা শুধু আরেকটা পায়ের উপর তুলে রাখলাম। উনার ভ্যানের বডিতে আমার পা বা জুতার ময়লা উঠেনি। তবুও তার চেহারা থেকে বিরক্তের ছাপ কাটলো না। আমি সেদিকে আর নজর দিলাম না। অটো ভ্যান যেহেতু সেহেতু বেশ দ্রুত গতিতেই চলছিল। পিচঢালা পথ। রাস্তার নিচে দুই পাশে ফসলি জমি। চারিদিকে আধাপাকা ধান। না সবুজ না হলুদ এমন একটা দৃশ্য। রাস্তার দুই ধারে এত সবুজ ঘাস! ছোট ছোট ঝাউ গাছ। বেশ সতেজ লাগছিল আমার। চারিদিকে এত সবুজ গাছপালা! অনেকটা দূরে দূরে এখানকার বাড়িঘর। ঘনবসতি না। প্রতিটা বাড়ির উঠোন সবুজ গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে যেন। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। চারিদিকটা দেখতে দেখতেই চলে আসলাম ফুলতলা। ভ্যান থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে একটা দোকানে গেলাম সিগারেট খেতে। কিন্তু দোকানদার হুজুর। সিগারেট বিক্রি করেন না। তাই মিষ্টি জর্দা দিয়ে একটা পান চাইলাম তার কাছে-
‘এখান থেকে দক্ষিণ দিকে রাস্তাটা কোথায় গেছে?’
‘আপনি এখানি নতুন আসিছেন?’
‘হ্যা।‘
‘ওহ, এই রাস্তা চলি গেছে তালবাড়িয়া।‘
‘ওহ, আর পশ্চিম দিকের রাস্তাটা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?’
‘এই নেন আপনার পান। আর দুঃখিত সিগারেট দিতি পারলাম না। আমি নামাজ পড়ি। নেশাদ্রুব্য বেচি না।‘
‘আচ্ছা ধন্যবাদ। আসি।‘
‘আচ্ছা ঠিক আছে, ইয়ে ভাইজান ওই রাস্তাটা শেখহাতী হয়ে চলি গেছে একদম কোটের মোড়।‘
উনাকে আবার ধন্যবাদ দিলাম। পাশের দোকান থেকে সিগারেট ধরিয়ে পুরো ফুলতলা মোড়টা ভালো করে দেখলাম। হাতে গোনা কয়েকটা দোকান। মোড়ে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ বেশ ছায়া দিয়ে রেখেছে। লোকজন গাড়ি খুব কম এখানে। ছোট্ট একটা জায়গা আর কি! তবে বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন সেখানকার রাস্তাগুলো। বিকেল চারটা পনের বাজে। কোন ভ্যান বা ইজিবাইক নেই।এইদিকে খুব কম চলাচল মানুষের। আমি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে স্লোমোশনে টানতে লাগলাম। কয়েকটা টান দিতেই একটা ইজিবাইক এলো। তাতে চেপে বসলাম। ইজিবাইকও টানতে শুরু করলো। গ্রামের আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথে এগিয়ে যাচ্ছে ইজিবাইক। এখানকার রাস্তাগুলো এত সুন্দর। কোথাও ভাঙা নেই। রাস্তার উপর কেউ কোন কিছু রাখেনি। শেখহাতীর আগে ফসলি জমির মধ্যদিয়ে এই রাস্তা চলে গেছে একদম বাবলাতলা বা কোটের মোড় পর্যন্ত। রাস্তার দুই পাশে বেশ বড় বড় কিসব গাছ। পুরো রাস্তাটাকে ছায়ায় আগলে রেখেছে একদম। যদিও ততক্ষণে রোদ অনেকটা পড়ে গেছে।
শেখহাতি পাড় হয়ে বেশিক্ষণ লাগলো না কোটের মোড়ে আসতে। ইজিবাইক থেকে নেমে সোজা গেলাম একটা চায়ের দোকানে। কপালে ঘাম অনুভব করলাম। পান খেয়েছিলাম বলে হয়তো। যাহোক, চা খেয়ে ওখানে আর দেরি করলাম না। আরেকটা ইজিবাইকে উঠে মণিহার সিনেমা হলের উদ্দ্যেশে রওনা দিলাম। উপমহাদেশের বৃহত্তর সিনেমা হল মণিহার। সিনেমা হলের নাম অনুসারে ঐ জায়গার নাম করণ করা হয়েছে। বাবলাতলা থেকে অল্প কিছুদূর আসার পর রাস্তার বেহাল দশা চোখে পড়লো। যদিও এই রাস্তাটা যশোরের মেইন রোড। যেটাকে ঢাকা রোড বলা হয়।প্রায় মণিহারের আগ পর্যন্ত এমন ভাঙা খাদ রাস্তায়। খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। ইজিবাইকের ঝাকিতে আমার ভূড়ি আর স্তন লাফাচ্ছিল। অনেকটা অস্বস্তি লাগছিল বটে। মণিহারে নেমেই আগে একটা হোটেলে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিলাম। বাহিরে এসে একটা চা খেতে খেতে সিগারেট জ্বালালাম। চা সিগারেট খাওয়ার পর ঘড়িতে দেখি পাঁচটা সাত বাজে। আর দেরি করলাম না। মণিহার থেকে আরেকটা ইজিবাইকে উঠে রওনা হলাম রাজার হাট।
একদম খুলনা যশোর হাইওয়ে দিয়ে ইজিবাইক যাচ্ছিল। অনেক বড় ও ব্যস্ত রাস্তা। তবুও ইজিবাইক বেশ দ্রুত টেনে যাচ্ছিল। হুশতলা, বকচর, মুড়লী পাড় হয়ে একদম রাজারহাটে চলে এলো। বারো থেকে পনের মিনিট লেগেছে মাত্র। যদিও আমি রাজারহাট মোড়ের আগেই কাচা বাজারে নেমেছি। কোন বাজার করবো না জেনেও পুরো বাজারটা ঘুরলাম। এক দিক দিয়ে ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। সবুজ শাকসবজিগুলো আমার দেখতে খুব ভালো লাগে।রংবেঙের সবজি। প্রতিটা সবজির আলাদা গঠন। আলাদ রঙ। আলাদা স্বাদ।আহা!
কাচা বাজার থেকে নেমেই ভৈরব নদী। নদীর উপরে ব্রিজের কাজ হচ্ছে। গত চার বছর ধরেই হচ্ছে। কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। মানুষের যাতায়াতের জন্য পাশেই আগের পুরোনো ভাঙা ব্রিজের কিছু অংশ নিয়ে বাঁশ কাঠ দিয়ে কোন মতে চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।আমাকে নদী পাড় হতে হবে। কিন্তু নিচে নামতেই নাকে ফাস্টফুডেরর ঘ্রাণ ভেসে এলো। চারিদিকে দোকান খুঁজলাম। পেলাম না। অথচ নাকে আরও তীব্রভাবে ঘ্রাণ আসছে। আরেকটু নিচে নামতেই দেখি একটা দোকানে ভাজছে সব। লোভ সামলাতে না পেরে বসে পড়লাম। গরম গরম সব খেয়ে উঠতে যাবো ঠিক তখনি মায়ার কল-
‘সাকি আমি যদি মরে যাই।‘
‘তাইলে আমি আরেকটা বিয়ে করবো।‘
‘এই ছিলো তোমার মনে না? হাহা।‘
মায়ার মন খারাপ আমার ভালো লাগে না। তাই একটা কথাতেই ওরে হাসিয়ে তুললাম। সামনের ষোল তারিখে ওর ডেলিভারি ডেট দেওয়া আছে। যদিও বাড়িতে মা আছে, তবুও আমার ভয় ওরে নিয়ে। মানুষটাকে অসম্ভব ভালোবাসি। ভালোবাসাকে ব্যখ্যা করা যায় না। ভালোবাসা অনুভবের ব্যাপার। বিয়ের আজ এগারো বছর। মনে পড়ে না লাস্ট কবে ওরে বলেছি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি! কারণ ভালোবাসা এমন একটা অনুভূতি যেটা কোন শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। এটাকে অনুভব করতে হয়। ভালোবাসি শব্দটা পুরুষের চাহনিতে থাকে। পুরুষের যত্নে থাকে। পুরুষের হাসিতে থাকে। তবুও নারী মুখেই শুনতে চায়। অনুভূতি ছাড়া হলেও মুখেই শুনবে। ওদের শুনতেই ভালো লাগে।
ভৈরব নদী পাড় হয়ে সীতারামপুরের রাস্তায় আসলাম। এই রাস্তাটা একদম খোলা পাথারের মধ্যদিয়ে সরু পিচঢালা পথে এঁকেবেঁকে চলে গেছে হামিদপুর বাজারে। যেখান থেকে আমি দক্ষিণ দিকে রওনা দিয়েছিলাম।
নদীর এ পাড়ে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না। একটা ভ্যান পেয়ে গেলাম। তবে কপাল খারাপ এবার ডান পাশে বসতে হলো। যদিও সামনে বসেছি। বাম পাশে আরেকজন মুরুব্বী বসা। দুইজনকে নিয়েই ভ্যানওয়ালা ভ্যান ছেড়ে দিলো। কয়েকটা বাড়িঘর পাড় হয়ে ফসলি জমির মাঠে এসে পরলাম আমরা। রাস্তার দুই ধারে ধান ক্ষেত। রাস্তার পাশে কিসব ঝাউ গাছ। দারুণ এক গ্রামীণ পরিবেশ।
সীতারামপুর পার হয়ে হামিদপুরের রাস্তায় উঠতে যাব ঠিক তখনি সামনে দেখলাম একটি লাশবাহী গাড়ী অপর দিক থেকে ছুটে আসছে। রাস্তাটা এল প্যাটানের। আমরা ডানে মোড় নিব আর গাড়ীটা বামে মোড় নিবে।লাশবাহী গাড়ীটা দেখেই বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো। ভ্যানটা ডানের মোড় পাড় হয়ে যাচ্ছিল। সামনে লাশবাহী গাড়ীটা বেশ দ্রুত আসছে। সরু রাস্তা এত জোড়ে চালানো মোটেই ঠিক হচ্ছিল না। ত্রিশ চল্লিশ গজ সামনে যখন লাশের গাড়ীটা তখন আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। দেখলাম গাড়ীর উপরে কেমন অদ্ভুত একটা জন্তু দাঁড়িয়ে আছে। দুই পা দুই হাত মেলানো। কিন্তু পুরো শরীর কালো। বড় বড় দাঁত দেখা যাচ্ছিল তার। আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ংকরভাবে হাসছিল। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। ভ্যান আরেকটু সামনে যেতেই লাশের গাড়ীর উপর থেকে সেই ভয়ঙ্কর জন্তুটা এক লাফে আমার বুকের উপর এসে হামলে পরে। আমি ভ্যানের বডির উপর পরে যাই। লাশের গাড়ীটা ডান পাশের ধান খেতে মধ্যে চলে যায়। আর ভ্যানটা তখনো অনেকটাই রাস্তায়। একটুখানি সামনের চাকা নিচে নেমে গেছে। তবে বাম পাশে বসা মুরুব্বী ধান ক্ষেতের মধ্যে ছিটকে পরে। ভ্যানওয়ালা ভ্যানের সামনের চাকার উপর পরে যায়।
যদিও রাস্তা ফাঁকা। তবুও দূর থেকে যারা ঘটনা দেখেছে বা সামনে পিছনে যেসকল গাড়ী ছিল তাদের চালক ও যাত্রীরা দৌড়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজনে ভরে যায় ঘটনাস্থল। আমি তখনো ভ্যানের বডির উপর পরে আছি। আমার মাথা ফেটে গেছে অনেকটা। লাশবাহী গাড়ীর লুকিং গ্লাসের সাথে আমার মাথা লেগে গিয়েছিল। লুকিং গ্লাস ভেঙে গেছে। ভ্যানের বডি থেকে মাটিতে টপটপ করে রক্ত পড়ছিল আমার শরীরের। ভ্যানওয়ালা কাঁদতে কাঁদতে বারবার আমার দিকে সবাইকে দেখতে বলছিল। লোকজন এসে আমাকে ধস্তাধস্তি করে তুললো আরেকটা ভ্যানে। হাসপাতালে নিবে। কিন্ত ততক্ষণে আমি মারা যাই।
দূরে কোন মসজিদে মাগরিবের আযান শুরু হলো- আল্লাহ আকবার, আল্লাহ আকবার।
সবাই খুব কান্নাকাটি করছিল। ওখানে কারোই তেমন বড় কোন ক্ষতি হয়নি। ভ্যানওয়ালা ও বাম পাশের যাত্রীর হাত পা ছিলে গেছে অনেকটা। লাশের গাড়ীর চালকের কপাল ফেটে গেছে একটু। আমি মারা গেছি জেনে কেউ আর আমাকে হাসপাতালে নিলো না। অচেনা সব মানুষ, তবুও কান্নার রোল পরে গেল সেখানে। কেউই আমাকে চিনতে পারলো না। যে আসে সেই মুখটা ভালো করে দেখে। কিন্তু কেউ চিনে না। শেষ পর্যন্ত একজন আমাকে চিনলো এবং ডুকরে কেঁদে উঠে ওখানেই জ্ঞান হারালো।
চারিদিকে আবছা অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে শুরু করলো। মায়ের বয়সী এক মহিলা তার বাড়ি থেকে একটা ওড়না নিয়ে এসে আমার লাশটা ঢেকে দিলো। কেউ কেউ পুলিশকে কল করলো। ফায়ার সার্ভিসও জেনে গেলো। এর মধ্যেই জ্ঞান হারানো ব্যক্তির জ্ঞান ফিরে যায়। উঠেই আবার কান্না শুরু করে। ব্যক্তিটা হলো শ্রী বিল্লু দাশ। বিল্লু হামিদপুর বাজারে ব্যাগ জুতা বিক্রি ও সেলাই করে। আমি মাঝেমধ্যেই জুতা পালিশ করে নিতাম তার কাছ থেকে। বেশ ভালো জানাশোনা আমাদের। তাই আমার মরা মুখটা দেখে সে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সবাই মিলে তার মাথায় পানি দিলো। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলো আমাকে সে চিনে কিনা? সে কান্না করতে করতে জানালো যে- 'আমি উনারি চিনি। উনার বাড়ি বগুড়ায়। এনে চাকরি করে ওষুধ কোম্পানিতে। উনি হামিদপুরে বাসা ভাড়ায় থাকে।'
যে আসছে, এসেই আগে আমার লাশের উপর থেকে ওড়না তুলে আমার রক্তাক্ত মুখটা দেখছে। কেউ কান্না করছে কেউ আফসোস করছে। আমি মরে পরে আছি একটা ভ্যানের বডির উপর। আমি মরে গেছি অথচ আমার বাড়ির কেউ জানলো না এখনো। আমার মা জানলে নিজেকে কীভাবে সামলাবে? আমার গর্ভবতী স্ত্রী জানলে কীভাবে ঠিক থাকবে? তারা এখনো হয়তো আমাকে জীবিত ভাবছে। আমার মা হয়তো ভাবছে এবার আমি বাড়ি গেলে ডালের বড়া করে খাওয়াবে। বউ হয়তো ভাবছে যদি এবার কন্যা সন্তান হয় তাহলে আমার দেওয়া সুহা নামটাই রাখবে। অফিসের বস আমাকে দিয়ে আগামীকালের কাজের প্লান রেডি করে রেখেছে হয়তো। বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা না জানি কত প্লান প্রোগ্রাম করে রেখেছে। অথচ আমি মরে গেছি। পৃথিবীতে আমার লাশ ছাড়া আমার আর কিছুই নাই। একটু পরে হয়তো সবাই জানবে। আর আফসোস করবে। অথচ মৃত্যু আফসোসের নয়। মৃত্যু আনন্দের। নিজের সৃষ্টিকর্তার নিকটবর্তী হবার মৃত্যুই একমাত্র পথ। আমি সেই পথ পাড়ি দিয়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছেছি। আমি জয়ী। আমি আগে এসেছে।


0 Comments