কার্ভিং নাইফটা দিয়ে কাঠের টুকরোটাকে একটি মুখাবয়বে রূপান্তরিত করায় ব্যস্ত ছিল সে। মুখটার প্রতিটি অঙ্গকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য খুব সাবধানে সে তার হাতটাকে চালিয়ে যাচ্ছে। তার হাতের স্পর্শে প্রাণ পেয়ে ওঠা মুখটিতে চোখ জোড়া সর্বাধিক আকর্ষণীয় করার জন্য সে একান্ত চিত্তে মনোনিবেশ করছে। শব্দের চেয়ে বেশি এক জোড়া চোখের সংবেদনশীলতা তাকে মুগ্ধ করে। মনের মধ্যে এঁকে নেওয়া প্রতিমূর্তিটাকে তার অভিজ্ঞ হাত দুটি দিয়ে নিখুঁতভাবে গড়ে যেতে থাকল। যতই শেষ পর্যায়ের দিকে এগিয়ে চলেছে ততই তার উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে। এক ধরনের পরিশীলিত ব্যগ্ৰতা হয়তো প্রতিটি সৃষ্টিকামী সময়ে সময়ে নিজের চেতনায় ধারণ করে।
পেইন্ট ব্রাশটা দিয়ে বেইছ কালারটাতে অন্তিম স্পর্শ দিচ্ছে সে। চোখের মনিগুলি আরও কিছুটা উজ্জ্বল করে তুলেছে।মণি দুটির উজ্জ্বলতায় সাদা অংশটা সাদা যদিও সামান্য নীলের একটা ছাপ পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। সে পুনরায় একবার সম্পূর্ণ হয়ে উঠা মুখটাতে চোখ বুলালো। বছরজোড়া সাধনায় সে ইতিমধ্যে একজন অভিজ্ঞ ভাস্কর্য শিল্পী হয়ে উঠেছে। অবশ্য তাঁর সৃষ্টিসমূহ কেবল সে আর তার ঘরের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে থাকে। ঘুণাক্ষরেও এই বিষয়ে আর কেউ জানে না। তার একক পৃথিবীটাকে কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছা তার নেই। সে কৃতজ্ঞ যে এই শিল্পকলাই তার একাকীত্বকে প্রতিটি মুহূর্ত ভরিয়ে রেখেছে।
সে উৎসাহের সঙ্গে মুখটা দুহাতে তুলে নিল। প্রতিটি অঙ্গকে সে আলগোছে একবার স্পর্শ করে দেখছে। যে স্পর্শে লেগে রয়েছে সৃষ্টির অমল সুখ। এক টুকরো কাঠও কী এক সুকোমল হৃদয়জ অনুভব বহন করে আনতে পারে।
সে তার বুকটা একটুখানি ছুঁয়ে দেখল। জীবন্ত পাথরের টুকরোটা এক পলকের জন্য নড়েচড়ে উঠল।
কিছুক্ষণ পর্যন্ত তার দুটো চোখ মুখটার চোখ জোড়ায় নিবদ্ধ হয়ে রইল। হঠাৎ, একটা প্রশ্নবোধক এসে তার কপালের রেখা গুলিকে অধিক গাড় করে তুলল। তার চোখ মুখ মুছে সে পুনরায় মন দিল সম্পূর্ণ হয়ে ওঠা মুখটিতে। চোখ জোড়া দুটিকে পুনরায় খুঁটিয়ে দেখল।
সত্যিই কি? নাকি এটা তার ভ্রম!
এই চোখ জোড়া…এই দৃষ্টি…!
কোথায় যেন অপ্রত্যাশিত কিছু একটা ঘটে গেছে। ভুলে যেতে চাওয়া এক প্রাচীন সত্যের সঙ্গে সে যেন পুনরায় মুখোমুখি হতে চলেছে। দূরে সরে আসার অপ্রাণ চেষ্টা করার পরেও এক বিশেষ বিন্দুতে যেন সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এরকম হওয়ার তো কথা ছিল না…
তার অতীতটাকে একপ্রকার নিশ্চিহ্ন করে ফেলল বলেই এতদিন সে নিজের প্রতি এক গভীর বিশ্বাস গড়ে তুলেছিল। সামনের পথটাকে নিজের ইচ্ছায় সাজিয়ে তুলতে জানা মানুষ সে। স্মৃতি কাতরতা ত্যাগ করতে পারার মতো স্বাভিমানীও।
এই মুখটা সম্পূর্ণ হয়ে উঠার ঠিক এক সেকেন্ড আগে পর্যন্ত সে নিজের প্রতি এরকম একটি ধারণায় বিশ্বাসী ছিল। সে কিছু সময়কে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারার মতো স্থিতগ্রজ্ঞ। সমাজের দৃষ্টিতে একজন ‘প্রকৃত পুরুষ’এর সংজ্ঞাকে নিজের মধ্যে ধারণ করার এই কসরত তার বহু যুগের। অসহজ কথাগুলিকে সহজ করে তোলার কৌশল সে শৈশবেই শিখে ফেলেছিল।
কিন্তু হঠাৎ তার কেন এরকম মনে হচ্ছে নদীর ঘূর্ণিপাকের মতো এক ঝাঁক স্মৃতি এসে তাকে পলকের মধ্যে ঘিরে ফেলেছে। একটি নির্জীব কাঠের টুকরোও বহন করে নাকি যাতনা বিলাস! না তার বুকের পাথরটার চারপাশে স্মৃতিগুলি বলয়াকারে আঠা লেগে আটকে আছে।
সে অস্থির হয়ে উঠেছে।
যন্ত্রণার একটা নিশ্বাসে তার হাতের রং মোছার জন্য ব্যবহার করা শতচ্ছিন্ন কাপড়ের টুকরো সামান্য কেঁপে উঠল।ঠিক তার বুকের ভেতরটার মতোই।
কতদিন হল বোধহয় এই ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’শব্দটার সঙ্গে তার মিত্রতা হওয়া। সে ছোটো ছিল।অন্তত সমস্ত কথা বুঝতে পারার পারার মতো তখনও পরিপক্ক হয়ে উঠেনি সে।সমস্ত কথাকে আলোকমুখী বলে ভাবার বয়স ছিল সেটা। ভরদুপুরবেলা মাঠটার পাশের গাছে বেয়ে পানিয়ল চুরি করে খাওয়ার দিন ছিল সেটা। নদীতে সবাই মিলে ঝপাং ঝপাং লাফিয়ে সাঁতার কাটার বয়স ছিল সেটা। সেই নির্দোষ ধামালিতে পরিবেষ্টিত জীবনগুলিতে জটিলতার ফাঁকফোকরই বা কোথায় ছিল!
অথচ ওদের কোমল মনগুলি বুঝতে পারা সহজ কথাগুলিকে নস্যাৎকরে সমাজটা শিখিয়েছিল—‘ছেলেদের কাঁদা ঠিক না। ছেলেরা বজ্রের মতো কঠোর এবং সাহসী হলে মানায়।মিনমিনে স্বভাব ছেলেদের পুরুষত্বে আঘাত হানে।’
শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। সেই কথাগুলি ব্রহ্মবাক্য হয়ে থেকে গিয়েছিল তার জীবনের জন্য। জীবন তাকে কতবার কাঁদানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল তার হিসেব সে রাখেনি। অথচ প্রতিবারই সে আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে স্থিতপ্রজ্ঞ হয়ে থাকার অভ্যাসের চর্চা করে গেছে।বুকটাকে যন্ত্রণায় চেপে ধরলেও সে বাহ্যিকতায় নির্লিপ্ত হয়ে থাকার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। সে জীবন থেকে এটাই শিখেছে, পুরুষ কাঁদে না। কাঁদার অধিকার পুরুষের থাকে না। পুরুষ মানেই স্থিতপ্রজ্ঞ। হাজার ঝড় তুফানেও সামান্যতম হেলে না পড়া মানুষই আসল পুরুষ।
কথাগুলি সত্যিই সহজ ছিল না।
বড়ো কষ্টের সঙ্গে সে যন্ত্রণাকে গিলে খাবার কৌশল আয়ত্ত করেছিল…
তার মনে আছে, খুব ভালোভাবেই মনে আছে। ঠাকুরমার সঙ্গে তাকে ঘিরে থাকা পিতা-মাতা তার জন্য একটা আকাশ হয়ে উঠতে পারে নি। জীবনবোধ এবং আদর্শের পার্থক্য ওদের ঘরের বাতাসকে সবসময় উত্তপ্ত করে রেখেছিল। তার শৈশবে ছিল না পিতার পিঠে উঠে,মাথায় গায়ে ঘুরে বেড়ানো ভালোবাসার আব্দারগুলি অথবা মায়ের স্নেহমাখানো কণ্ঠস্বর। তার শৈশব বললে এক ঝাঁক তুফানের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ঠাকুরমার চাদরের ভাঁজে লেগে থাকা ঘাম এবং ভাতের মাড়ের মিশ্রিত গন্ধ। দায়িত্বে ভারী হয়ে পড়া ঠাকুরমার দাগ লাগা হাতটার কথা মনে পড়ে তার। সকাল বিকেল মায়ের কাতরোক্তি তার মনটাকে চেপে রাখার কথা তার মনে পড়ে। পিতার ফুলে থাকা মুখ থেকে মায়ের প্রতি ছিটকে আসা শব্দের তীরগুলি তার স্পষ্টভাবে মনে পড়ে। মা দুর্বল দেহে বাবার উদ্দেশ্যে দৌড়ে এসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে দেওয়া প্রত্যুত্তরগুলি তার মনে পড়ে। অথচ সে সেই সময়গুলিতেও একটুকরো পাথর হয়েছিল। নিরুদ্বেগ, নির্লিপ্ত।
সে হয়টো তখনই স্থিতপ্রজ্ঞ হয়ে থাকার কৌশলগুলি শিখেছিল এবং বুঝেছিল সম্পর্কের মধ্যে থাকা জটিল বিভেদগুলি। হৃদয়ঙ্গম করেছিল চিরন্তন নিয়মের মধ্য দিয়ে বাঁধা পড়া সম্পর্কগুলির মধ্যেও থাকতে পারে এক বিশাল শূন্যতা। সমাজসৃষ্ট সম্পর্ক একটাকে রক্ষা করার স্বার্থে নিজস্বতা হারানোর সপক্ষে সে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিল না। যেখানে অন্তরের দাবি থাকে না সেরকম সম্পর্কের মূল্যই বা কি?
কখনও বুকটাতে বেশি করে একটা ব্যথা খোঁচা দিয়ে ধরলে সে দৌড়ে গিয়ে ঠাকুরমার বুকে ঢুকে গিয়ে অনেকক্ষণ সেভাবেই পার করত।ছোটো চুলগুলির ভাঁজে ঠাকুরমার খসখসে আঙুলগুলির স্পর্শে তার কোমল মনটাকে যেন রূপকথার একটা দেশে নিয়ে গিয়েছিল। সে আশা করেছিল, সেই স্পর্শ যদি কোনোভাবে তার মায়ের আঙুলগুলির হত। একফাঁকে ঠাকুরমা আদরের সুরে তাকে বলেছিল—‘ছেলে হয়ে তোর কীসের এত দুঃখ? ছেলেরা কি কাঁদে নাকি! তোর সঙ্গীদের দেখ, কীভাবে উদ্যাম হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কথাগুলি এভাবে ভাবতে ছাড়।’
ঠাকুরমার গালে চট করে একটা চুমু খেয়ে সে লজ্জিভাবে সরে এসেছিল। না! আর এরকম সে কখনও করবে না। দুঃখকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে পুরুষত্বের অহঙ্কার কখনও হারাতে চায় না। বুকটা সে ছুঁয়ে দেখেছিল,একটা জীবন্ত পাথরের জন্ম হয়েছিল বুকের এক কোণে।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণটাকে বুঝে উঠার সময় আদরের ঠাকুরমাও তার জীবন থেকে নাই হয়ে গিয়েছিল। একটা আগুনের শিখা ঘিরে ধরা ঠাকুরমার মুখটা তাকে কয়েকটা রাত ঘুমোতে দেয় নি। একটা সম্পর্কের স্থায়িত্বের খোঁজে তার মনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। আসলে সত্য কী? জীবন না মৃত্যু! মৃত্যু মানে যদি সমস্ত কিছু শেষ তাহলে আজও কেন সে ঠাকুরমার বুকের উষ্ণতার খোঁজে হাহাকার করে উঠছে!ঠাকুরমাকে ঘিরে ধরা আগুনের সঙ্গে তার সেই অনুভূতিটুকুও ধ্বংস হয়ে যেত যদি! পরে, খারাপ লাগলে সে নদীর তীরে নিঃসঙ্গ গাছগুলির কাছে যেত।ঠাকুরমাকে বলতে ইচ্ছা করা কথাগুলি সে গাছটার সঙ্গে ভাগ করে নিত। তার শূন্যতার সমভাগী হয়েছিল গাছটি। গাছটি তাকে ঠাকুরমার মতোই একবুক ভালোবাসা দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল। মাঝেমধ্যে গাছটির কাছে নাকটা নিয়ে এসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিত। ঠাকুরমার গায়ের গন্ধটার মতোই গাছটারও নিজস্ব একটি গন্ধ ছিল। কখনও ভুলতে না পারা সেই গন্ধটি তাকে রাতে স্বপ্নেও তাড়া করে বেড়াত।ঠিক ঠাকুরমার মতোই। গাছটি যুগ যুগ ধরে অপোসবিহীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মতো সেও যেন আয়ত্ত করে নেবে সেই অহংকার। সৃষ্টির তাড়নায় সবুজ হয়ে থাকা গাছটির অস্তিত্ব তাকে একদিন আকাশমুখী পথটির সন্ধান দিয়েছিল।
কত বছর, কত বছর আগের কথা ছিল এটা! কতদিন, মাস বছর পার করল সে গাছটির কাছে না গিয়ে!
সে যে অত্যন্ত গোপনতার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিল গাছটার প্রতিটি ডাল পাতা, ডালপালার সঙ্গে। সেদিন গাছটা কেঁপে উঠেছিল নাকি! হয়তো কেঁপেছিল। সেই সত্য বড়ো সহজ ছিল না। যে সত্যকে আবিষ্কার করার সময় সেও হয়তো একবার কেঁপে উঠেছিল?
…গাছটার বাইরেও আর কে জানত সেই সত্য! জানত, দ্বিতীয় এক সত্তা তার সেই সত্য জানত। আসলে সে স্বীকার করেছিল তার আগে এক অবিশ্বাস্য অনুভূতিকে অন্তত তখন তার সেই অনুভূতিকে অবিশ্বাস্য বলে বলার অবকাশ ছিল। সন্ধ্যাবেলার ছায়া আলোর মধ্যেও দীপ্তিমান হয়ে থাকা চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে সে বলে ফেলেছিল– ’তোকে কেবল শৈশবের বন্ধু বলে মেনে নিতে পারছি না আমি। কিছুটা এক নিজেও বুঝতে না পারো অনুভব আমাকে কিছুদিন থেকে অস্থির করে তুলেছে। অবশেষে আমি এটাই বুঝেছিলাম, একমাত্র তুইই দূর করতে পারবি। তোকে আমার ভালো লাগে। আমার এই ভালোলাগা, কেবল একজন বন্ধুর প্রতি থাকা ভালো লাগা নয়। তুই বুঝতে পেরেছিস কি আমি তোকে কি বোঝাতে চাইছি?’
…না, আমি বুঝতে পারিনি তুই কী বোঝাতে চাইছিস। ভালোভাবে বলতো।’
বন্ধু বুঝতে না পারা কথাগুলি বলতে আমার বিশৃঙ্খলা লাগেনি। শৈশব কৈশোর একসঙ্গে পার করে আসা বন্ধুর প্রতি তার হৃদয়ের অনুভূত হওয়া বিশেষ অনুভব বিনা দ্বিধায় বলে ফেলেছিলাম। বন্ধুর প্রতি থাকা ভালো লাগা কখন অনুরাগে পরিবর্তিত হয়েছিল সে নিজেও জানে না, কিন্তু বন্ধুর সান্নিধ্য তাকে কীভাবে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে সেই কথা বলতে তার বিন্দুমাত্র সংকোচ হয়নি।বন্ধুর উষ্ণ হাতের স্পর্শের জন্য সে কীভাবে উদ্গ্রীব হয়ে উঠে সেকথা বলতেও তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না। সে কেবল হৃদয় উজাড় করে বলে গিয়েছিল…
বন্ধুর চোখ জোড়া থেকে নির্গত হওয়া আগুনের স্ফুলিঙ্গ তার সর্ব শরীর সেদিন দহন করেছিল। শৈশব কৌশোরের পরিচিত চোখ জোড়ায় কখনও না দেখা ঘৃণা দেখতে পেয়েছিল সে। হয়তো সেদিন সে সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছিল, শব্দের চেয়েও দু চোখের ভাষা বেশি তীব্রতর। ধারাল।
প্রায় ঠেলে নিয়ে যাবার মতো করে নির্জন মাঠটাতে তাকে বন্ধু ছেঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল। বন্ধুর পেশীবহুল হাতের থাবাটা তার শার্টের কলারে পড়েছিল। বন্ধুর চোখের তীব্রতায় তছনছ হয়ে গিয়েছিল তার বুকের জীবন্ত পাথরটা…
‘কি যাতা বলছিস তুই! পাগল হয়েছিস? এই সমস্ত কথা অন্যেরা শুনলে কী হবে একবার ভেবে দেখেছিস! দেখবি কিন্তু,আত্মসম্মান এবং সমাজ দুটোই আমার বড়ো প্রিয়। এই এই দুটিতে দাগ পড়লে তোকে সহজে ছাড়ব না আমি।‘
প্রচন্ড একটা ঠেলায় সে মুখ থুবড়ে পড়ল। বন্ধুর প্রিয় চোখ জোড়ার দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে ছিল সে …
না না!
এটা তার বুকে দাগ কেটে যাওয়া বন্ধুর চোখ নয়। চোখ জোড়া তার অপরিচিত। আশৈশব তার সঙ্গে একসঙ্গে বড়ো হওয়ার, তার সমস্ত নির্দোষ ধামালির বিশ্বস্ত সঙ্গী এই বন্ধুর মধ্যে কোথায় লুকিয়ে ছিল এরকম একটি অপরিচিত পুরুষ? এটা সমাজপ্রীতি না ভয়? তার আত্মসম্মান নেই? নাকি এরকম অনুভব অসাংবিধানিক!
তার চিৎকার করে করে বলতে ইচ্ছা করছিল– আমার আবেগকে রোধ করার কথা বলিস না বন্ধু। নিষ্পাপ অনুভূতিগুলিকে শিকল দিয়ে বাঁধতে পারব না আমি। অনুভব গুলি স্বতঃস্ফূর্ত, সে লাগে হাসিই হোক অথবা বুক ভাঙ্গা কান্না! পুরুষত্বকে স্থিতপ্রজ্ঞতার সংজ্ঞায় কখনও মাপতে যাস না। পুরুষের হৃদয়ও নারীর মতোই সংবেদনশীল।
তারপরে…
তারপরে সে সেই চোখ জোড়াকে ভুলতে চেষ্টা করেছিল। জীবন্ত পাথরের টুকরোটা একটু বড়ো হয়েছিল। নিজেকে সে বুঝিয়েছিল, অনুভবের স্বকীয়তা থাকে না। পরাধীন। জীবন থাকা মানে আবেগকে বেঁধে রাখার খেলাটা প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। নিয়মের পরিধি ভেঙ্গে নতুনের দিকে পথ চলার সাহস প্রত্যেকের বুকে থাকে না। কিন্তু তার ছিল সেই সাহস। অনুভবের পরিমাপক থাকলে সে হয়তো দেখাতে পারত কতটা সতেজ অনুভবে ভরে আছে তার বুকের অলিন্দ-নিলয় সেই বন্ধুর প্রতি। তার মতো প্রত্যেককেই যদি সাহসী হত!
অবশেষে বিদায় নিয়েছিল প্রিয় শহরটি থেকে। নতুন জায়গায় সে বহন করে আনেনি তার প্রশ্নগুলি। ঝেড়ে ফেলব বলেই সে তার অতীতটাকে ঝেড়ে ফেলেছিল। স্থিতপ্রজ্ঞতার সংজ্ঞাকে সে তার মজ্জায় ধারণ করে নেওয়ায় একশভাগ সফল বলে সে ধরে নিয়েছিল।অথচ এক টুকরো কাঠে কেটে বের করা একটি মুখ তার সমস্ত ধারণাকে ইতিমধ্যে ভুল বলে প্রমাণিত করে ফেলেছে। কত বছর পার হল অথচ, প্রত্যেকের কাছ থেকে এক দূরত্বে অবস্থান করেও সে যেন আজও সবাইকে হৃদয়ে বহন করে বেড়াচ্ছে। সময় কত বদলে দিল তার পরিচিত সমাজকে, একবার জানার তীব্র আগ্রহ জাগল। একই নিয়মের গণ্ডিতে এখনো আছে কি তার পরিচিত মানুষগুলি… পুরুষ কাঁদে না ….পুরুষ স্থিতপ্রজ্ঞ!
তড়িৎ সিদ্ধান্তে সে আপন শহরটিতে ফিরে এসেছে।
আভিজাত্য ঘিরে রাখা শহরটির মধ্যে তার পরিচিত শহরটি হারিয়ে গেছে। পরিবর্তিত হয়েছে পরিচিত পথ ঘাটগুলি। আদরের পরিচ্ছন্ন ঘরগুলিকে উচু উঁচু দালান গুলি গিলে ফেলেছে। চারপাশে কেবল জীবনের উদযাপনের প্রতিযোগিতা। যান-বাহনে ব্যস্ত রাজপথ। দূরের কোথাও থেকে ভেসে আসছে উত্তাল সংগীতের ধ্বনি। সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ পৃথিবীতে। না এখানে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। হারিয়ে ফেলেছে সে ছেড়ে আসা নিজের এক টুকরো অস্তিত্বকে। তার দিকে তাকানোর মতো কারও সময় নেই।
একটি ক্ষীণ আশা নিয়ে সে দুই একজনের কাছে গেল। কেউ একজনতো তাকে দেখে আবেগিক হোক! এত বছর কোথায় কীভাবে ছিল বলে তার খবর জিজ্ঞেস করুক! কিন্তু না! সেরকম কিছু হল না। সে থাকা অথবা না থাকার মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য হয়তো কারও অস্তিত্বে বহন করছে না। কারও কাছে বিশেষ হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। সত্যিই কারও কাছে বিশেষ হয়ে উঠতে পারল না সে। সেই বন্ধুরও হল না। সেও কি তাকে শহরটির মতোই ভুলে গেছে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। হয়তো কিছুটা উত্তেজিতও হয়েছে। একবার বুকটা ছুঁয়ে দেখল, পাথরটা খলখল করে উঠল।
তার গাছটা!
তার প্রিয়বন্ধু তাকে মনে রেখেছে কি…
না না! সেই বন্ধুত্বে কোনো শঠতা ছিল না। তাকে গাছটা অন্তত ভুলতে পারবে না। স্থিতপ্রজ্ঞ, পুরুষসুলভ অহঙ্কারে তার প্রিয় বন্ধুকে আজ সেও বলবে–‘দেখ আমার বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে তুমি চাওয়ার মতোই আমি আকাশমুখী হয়ে রিলাম। তুমি আজ সুখী তোঁ বন্ধু?’
উদ্ভ্রান্তের মতো সে নদীর তীরের গাছগুলির কাছে দৌড়ে গেল।
ঐ যে তার পরিচিত তার নদীটা।
অন্ধকারে নদীটার তীরে তার প্রিয়বন্ধুকে দূর থেকে কালো একটা ছায়ার মতো দেখাচ্ছে। সে তার দৌড়ের গতিবেগ বাড়িয়ে দিল। সোঁ সোঁ করে বইতে থাকা নদীতীরের ঠান্ডা বাতাসে তার শরীরটা শিউরে উঠল।সে দাঁড়িয়ে পড়ার প্রশ্নই উঠে না।
গাছটাকে সে পরম আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল-‘বন্ধু দেখ আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি। তুমি, তুমি হয়েই আছ, নয় কি!’
গাছটা সামান্য কেঁপে উঠল-
‘তুমি দেরি করলে বন্ধু। অনেক দেরি করে ফেল্লে। তোমার বন্ধুকে সেদিন দেখেছিলাম। এখানে, অনেকক্ষণ বসে ছিল সে। বিশ্বাস কর, তাকে দেখে প্রথমে আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল।’
সে যেন নিজের কান দুটিকেই বিশ্বাস করবে না- ‘সে এসেছিল? সে সত্যিই আমার খোঁজে এসেছিল?’
গাছটা সামান্য হাসল,
‘না বন্ধু। সে তোমার খোঁজে এখানে আসেনি। প্রিয়তমা পত্নীর সঙ্গে সে এখানে এসছিল। হাতে হাত রেখে দুজনেই জীবনের কথা বলছিল। তাঁদের মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলি আমিও শুনেছিলাম। আমার ছায়ায় বিশ্রাম নিয়েছিল তারা। জান, আমার তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল।’
গাছটার কথায় আহত হল সে। হয়তো বিন্দুসম শেষ আশা একটা সে তখনও নীরবে বহন করে বেড়াচ্ছিল। অনেকদিন পরে একটা ব্যথা তার বুকে খোঁচা মেরে ধরল। ঠোঁটটা সামান্য কেঁপে উঠল। এই মুহূর্তে আকাশমুখী হয়ে থাকার অহঙ্কারও তাকে ছুঁতে পারে নি দেখছি। সে যেন গাছটাকে জড়িয়ে একবার কাঁদবে…
ততক্ষণে নদীটার জলটুকু কুসুম ফুলের মতো হয়ে উঠেছিল। অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে আসা সূর্যের হলদে আলোতে গাছটির সবুজ পাতা গুলি চকচক করে উঠেছিল। সে ছেড়ে যাওয়ার মতোই আকাশমুখী হয়ে থাকা গাছটার গন্ধটা একবার টেনে নিল সে।
‘আঃ!’
‘তুমি নিঃসঙ্গ নও বন্ধু। আমি আছি তোমার সঙ্গে। নিয়ম ভাঙ্গার সাহস প্রত্যেকের থাকে না। তুমি স্রোতের বিপরীতে একটি সমাজকে নিতে পার না, কিন্তু তোমার যুদ্ধটিকে স্বীকার করতে পারার মতো তুমি বিবেকবান হয়ে বেঁচে আছ। সেটা কি তোমার প্রাপ্তি নয়। তুমি একক। ভীরুতা অথবা সমাজ সচেতনতা তোমাকে বিচলিত করতে না পারার মতো তুমি স্থিতপ্রজ্ঞ। তুমি আমার চাওয়ার মতোই আকাশমুখী হয়ে বেঁচে আছ।যাও বন্ধু, ফিরে যাও তোমার ঠিকানায় । তোমার শিল্পী সত্তা তোমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।’
গাছটার কথায় সে একবার আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকাল। উজ্জ্বল রোদের আলোতে সে দেখতে পেল ঠাকুরমা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। তার মনে হল সে যেন এতদিন মৃত শরীরে রুপান্তরিত হয়েছিল। বুকে খাজ কেটে থেকে যাওয়া স্মৃতি বিজড়িত শহরটি মৃত হয়ে পড়েছে। তারা আত্মা থেকে গেছে তার নতুন ঠিকানায়,
সে লাফ মেরে উঠে বসল।
বাতাসে একবার ঠাকুমার গন্ধটা শ্বাস টেনে নিল সে। বুকের পাথরটাকে বহমান নদীতে খসিয়ে দিয়ে সে নির্ভর হয়েছে।
গাছটার বড়ো একটা ডাল জড়িয়ে সে ফিরে চলেছে তার সৃষ্টির দিকে।
কত যুগের শেষে এই মুক্তি…
0 Comments