পাড়ার লোকের হাসি থামে না। তারা শুনতে পেয়েছেন বদর মিয়া লিখতে শুরু করেছেন। এই খবরে যে যেভাবে পারেন হেসে নিচ্ছেন। একজন বললেন, হে আবার কিসের লেখক, এক লাইন শুদ্ধ করে বাংলা লিখতে পারত না, দুই বারে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। কথা শেষ হতেই হাসি। আরেকজন বললেন, আরে ঘটনা অন্য জায়গায়, পূব পাড়ার আম্বিয়ার পিছনে বদর মিয়া দুই বছর ধরে ঘুরতাছে, কিন্তু আম্বিয়া সারা দেয় না, আম্বিয়ার সারা না পেয়েই বদর মিয়া লিখতে শুরু করেছে। আবার হাসি। বয়স্ক একজন বলে বসেন, ধুর মিয়া তোমরা দেহি কিছুই জান না, বদর মিয়ার মামার বংশের প্রায় সবাই পাগল ছিল, ওরা গরমের দিনে মাথা ন্যাড়া করে রোদে বসে থাকত, আর শীতের দিনে কবিতা লিখত, বদর মিয়ারে মামার বংশের রোগে পাইছে। এরকম খবরে কেউ হাসেন কেউ গম্ভীর হয়ে যান।
তবে এলাকার লোক সব সময় সঠিক তথ্য জানেন না। বদর মিয়া সত্যিকারের লেখক, এবং তার পাঠকও আছে। বেশীর ভাগ পাঠক দূরের, তারা বদর মিয়াকে জানেন না। এলাকার লোকে তার লেখা পড়েন না। তবে এলাকার দুই একজন তার লেখা পড়েন, তারা বদর মিয়ার লেখার ভক্ত নন, তারা বুঝার চেষ্টা করে সাহিত্য আসলে কি, যদি বদর মিয়াও সাহিত্য রচনা করতে পারেন!
যা হোক এরকম একজন পাঠক বদর মিয়ার একটি লেখা পড়েছেন। বদর মিয়ার লেখাটা ছিল তালগাছ নিয়ে। তিনি একটি তালগাছ ঘিরে এক বিকেলের বর্ণনা করেছেন। তিনি লেখা শেষ করেছেন সন্ধ্যার বর্ণনা দিয়ে। বেশ ভালো লেখা।
বদর মিয়ার সঙ্গে এলাকার পাঠকের চায়ের দোকানে দেখা। পাঠক বদর মিয়াকে বলেন, ভাই আপনার তাল গাছ নিয়ে লেখাটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
বদর মিয়ার বুকের মধ্যে রক্ত ছলাৎ করে উঠে। তার মনে হয় পাঠককে বুকে জড়িয়ে ধরে এখনই একটি সেলফি তুলে ফেইস বুকে আপলোড করে দেন। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বদর মিয়া বলেন, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
পাঠক বলেন, আচ্ছা আপনার বাড়ির পেছনে তো তালগাছ নেই, নারিকেল গাছ আছে, আপনি কি ঐ নারিকেল গাছকেই তালগাছ বলেছেন?
- না, না, এটা আমার কল্পনার তালগাছ, এর সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই।
- মনে কিছু করবেন না, আমরা তো কবিতা বুঝি না, তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।
- ঠিক আছে, কোন অসুবিধে নেই।
- একটা বাদুড় যে গাছ থেকে চলে গেল, এটা দিয়ে কি আপনি জরিনাকে বুঝিয়েছেন?
- জরিনা কেন বাদুড় হতে যাবে!
- না, আপনার ভাবি বলল, জরিনা আপনার সঙ্গে থাকলেই ভালো হত! শুনেছি, জরিনার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তেমন ভালো না। জরিনা বড় কষ্টে আছে।
বিরক্তি নিয়ে বদর মিয়া এখানে একটু শুকনা হাসি হাসেন। এলাকার পাঠক নির্বিকার। তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন, ঐ যে মেঘের কথা লিখেছেন, এটা কি আম্বিয়ার কথা, যে আপনাকে এখনো ভাবায়?
- জি না, মেঘ বলতে আমি মেঘই বুঝিয়েছি, তালগাছের উপর দিয়ে সন্ধ্যের কালো মেঘ, দেখতে আমার খুব ভালো লাগে!
- আমরা তো আর এত বুঝি না। আপনি কবি মানুষ, কখন কি ভাবেন, কি লিখেন, কিছুই ধরতে পারি না।
এখানে বদর মিয়া খুশীতে গদ্গদ হয়ে একটু হাসেন। এই সুযোগে এলাকার পাঠক জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, যে গরুটা তালগাছের গোঁড়ায় বাঁধা, সেটাই কি আপনি?
বদর মিয়ার খুশী শেষ, তিনি রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করেন, আমি কেন গরু হতে যাব?
- গরুটার গলায় তো দড়ি বাঁধা, তাই ভাবলাম ওটা আপনি, দড়ি মানে সামাজিক নিয়ম, যে নিয়ম আপনি বাঁধা পড়ে আছেন, না পারেন জরিনার কাছে যেতে, না পারেন আম্বিয়াকে ভুলতে!
- আমি এগুলো কিছুই ভাবিনি, আমি একটি গরুকে দেখিয়েছি তালগাছের সঙ্গে বাঁধা।
- তালগাছ বলতে কি আপনি কাল বুঝিয়েছেন? যা দাঁড়িয়েই আছে!
- না, আমি তালগাছ বলতে তালগাছই বুঝিয়েছি।
- আমরা তো কবিতা বুঝিনা, তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম। সেদিন খাবার সময় আপনার ভাবি আপনার জন্য খুব দুঃখ করল।
- আচ্ছা।
- আপনার ভাবি বলল, কত পাগল ছাগলের জীবন কত সুন্দর হয়, আর আপনার মত সুন্দর মনের মানুষকে আম্বিয়া বা জরিনার জন্য কষ্ট পেতে হয়।
- আমি ওদের জন্য কষ্ট পাচ্ছি এ কথা আপনাকে কে বলল?
- আপনি মনে কিছু করবেন না, আমরা তো তেমন বুঝি না। তবে একই প্রশ্ন করতে পারি?
- অবশ্যই!
- আপনার সঙ্গে শরিফার কি হইছিল?
- হঠাৎ শরিফার কথা কেন?
- এমনিতেই মনে এল, বাতাসে নানা কথা ভাসে, আপনি কবি মানুষ, তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনি আবার মনে কিছু করেননি তো!
- জ্বী না।
- বুঝেনই তো আমরা কবিতা বুঝি না। তবে আপনার লেখা খুব ভালো লাগে। আপনার ভাবিও আপনার সব লেখাই পড়ে।
এ পর্যায়ে বদর মিয়া কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি চায়ের দোকানে কেন এসেছিলেন, তাও ভুলে গেছেন। তিনি এক গ্লাস পানি খেয়ে চলে গেলেন খাল পাড়ের দিকে।
0 Comments