মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। কবি ও লেখক। পিএইচডি গবেষক। ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ ৩১টি। এবছর তিনি ’শতবর্ষে চা শ্রমিক আন্দোলন: ডেডলাইন ২০ মে ১৯২১’ গ্রন্থের জন্য প্রবন্ধ-গবেষণা শাখায় ’কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার-২০২৪’ লাভ করেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: মিথ্যুক আবশ্যক (কাব্যগ্রন্থ), অন্য শহরের গল্প (গল্পগ্রন্থ), সাহিত্যের অনুষঙ্গ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (প্রবন্ধগ্রন্থ), চিত্রকলার জগৎ (প্রবন্ধগ্রন্থ), রবীন্দ্রনাথ ও চাঁদপুরের মানুষেরা (গবেষণাগ্রন্থ), শতবর্ষে চা শ্রমিক আন্দোলন : ডেডলাইন ২০ মে ১৯২১ (গবেষণাগ্রন্থ), বিরুদ্ধ স্রোতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, যাপনে উদ্যাপনে ইলিশ (সম্পাদিত গ্রন্থ), The sky in Your Eyes (Compilation Book) ইত্যাদি। তিনি সেন্টার ফর হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচারাল রিসার্চ-এর প্রতিষ্ঠাতা; সাহিত্য একাডেমি, চাঁদপুর-এর পরিচালক (গবেষণা); পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, কলকাতা এবং ইতিহাস একাডেমি, ঢাকার আজীবন সদস্য।
সম্প্রতি তার লেখালেখি, সাহিত্য ভাবনা, পুরস্কার প্রাপ্তি এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় সাহিত্য সাময়িকী 'উন্মেষ'র সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত।
উন্মেষ : গবেষণা ও প্রবন্ধ লেখা কেন বেছে নিয়েছেন?
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: আমি প্রায় পনের বছর সচেতনভাবে সাহিত্যচর্চায় যুক্ত রয়েছি। স্কুলজীবন থেকে কবিতা ও ছোটগল্পের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করি। কলেজে পড়াকালে প্রবন্ধ লিখতাম। ড. আনিসুজ্জামান, গোলাম মুরশিদ প্রমুখের লেখা মুগ্ধ হয়ে পড়তাম। সচেতনভাবে প্রবন্ধ লেখা শুরু হয় ২০১২ সালে। ২০১৭ সালে কাদের পলাশ ও আমি সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে নিয়ে ছোটকাগজ ‘ত্রিনদী’র বিশেষ সংখ্যা করতে উদ্যোগী হই। পরে কাজের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি পাঞ্জেরী পাবলিকেশন থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে নিয়ে কাজটি করার সময় আনিসুজ্জামান স্যারের সহযোগিতা নিই। তিনি আন্তরিকভাবে এ কাজে সহযোগিতা করেছেন। পাশাপাশি একটি ভূমিকাও লিখে দিয়েছেন। এ কাজটির পর মনে হয়েছে বৃহৎ পরিসরে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে পারবো।
পরে রবীন্দ্রনাথ, চা শ্রমিক আন্দোলনসহ কয়েকটি বিষয়ে গবেষণা করি। এসব কাজ সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। গবেষণা সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নিই। পরে এমএএস কোর্সে ভর্তি হই। এখন পিএইচডি করছি। এভাবে ধীরে ধীরে গবেষণা নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়ি।
উন্মেষ : ঐতিহাসিক চা‑শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে কেন আগ্রহী হলেন? বিষয়টি আপনার কাছে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: আমি চাঁদপুরের সন্তান। প্রায়ই চিন্তা করতাম, চাঁদপুরের এমন কোনো ঘটনা কি রয়েছে, যেটি জাতীয় গুরুত্ব রাখে। একসময় মনে হলো, ১৯২১ সালের ঐতিহাসিক মুল্লুকে চলো আন্দোলনের সঙ্গে চাঁদপুর যুক্ত। এখানেই হাজার হাজার শ্রমিক ব্রিটিশদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ ইতিহাসটি নিয়ে বাংলাদেশে কোনো গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। আন্দোলনটি সম্পর্কে তখন যৎসামান্য তথ্য পাওয়া যেত। অথচ ভারতবর্ষের অন্যতম আলোড়ন-সৃষ্টিকারী ঘটনাটি যথার্থ গবেষণার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে এটি নিয়ে কাজ করতে উদ্যোগী হয়েছি। এ কাজের অংশ হিসেবে আমি ভারতের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেও গিয়েছি। সেখান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছি। প্রায় দু-বছর এটি নিয়ে কাজ করেছিলাম। এ কাজটির গুরুত্ব যে ভারতবর্ষ-জুড়ে ছিল তা উপলব্ধি করেছিলাম। এ বইটি ১৯২১ সালের ২০ মে সংগঠিত চা-শ্রমিকদের রক্তাক্ত ইতিহাস ধারণ করে আছে। তাই বইটির নাম ‘শতবর্ষে চা শ্রমিক আন্দোলন: ডেডলাইন ২০ মে ১৯২১’ রেখেছি।
উন্মেষ : এ আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে আপনি কী কী উৎস ব্যবহার করেছেন?
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: ১৯২১ সালের চা-শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখলাম এ সংক্রান্ত তেমন কোনো বই নেই। আসামের গবেষক বিবেকানন্দ মোহন্ত কিছু কাজ করেছেন। তিনি পরে চাঁদপুরেরও এসেছিলেন। বইপুস্তক না-থাকায় আমি প্রথমে স্মৃতিকথা ও ইতিহাসগ্রন্থের আলোকে তথ্য বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু এসব তথ্যগুলো আন্দোলনের ত্রিশ, চল্লিশ বা তারও পরে লিখিত ছিল। আমি ১৯২১ সালের তথ্য চাচ্ছিলাম। পরে কলকাতায় ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব ইন্ডিয়াতে গিয়েছি। সেখান থেকে ওই সময়ের সংবাদভাষ্য সংগ্রহ করেছি। এছাড়া এ আন্দোলন সম্পর্কে তৎকালীন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিবেদন খুঁজে বের করেছি। অনেক দুর্লভ তথ্যপ্রাপ্তির কারণে কাজটি দ্রুত এগিয়ে যায়। এছাড়া স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অধ্যাপক ও গবেষক অর্ণব দে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। বাংলা একাডেমি, ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছি। মূলত বইটি লিখতে গিয়ে ১৯২১-২২ সালের তথ্যের উপর গুরুত্ব দিয়েছি বেশি।
উন্মেষ : ইতিহাস নিয়ে কাজ করার সময় আপনি দলিলনির্ভর থাকেন, না কি মৌখিক ইতিহাস বা প্রান্তিক স্মৃতিকে গুরুত্ব দেন?
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: আমি যে ধরনের কাজগুলো করেছি, সেখানে দলিলনির্ভরতা বেশি। তবে প্রান্তিক স্মৃতিও আমার কাজের সহায়ক হয়েছে।
উন্মেষ : একজন গবেষক হিসেবে আপনি ‘তথ্য’ এবং ‘দৃষ্টিভঙ্গি’র ভারসাম্য কিভাবে বজায় রাখেন?
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: গবেষণার জন্য তথ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য ও বিশ্লেষণের উপর ভর করে গবেষণা কাজ এগিয়ে যায়। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটতে পারে। আমি গবেষণায় নির্মোহ থাকতে চাই।
উন্মেষ : বাংলা ভাষায় গবেষণাগ্রন্থ বা প্রবন্ধের পাঠক তৈরি করতে হলে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: সমাজের যথাযথ বিকাশের জন্য চিন্তাশীল মানুষ প্রয়োজন। গবেষকরা অজানাকে কেবল জানান না, চিন্তাকে উসকেও দেন। ফলে গবেষণাগ্রন্থ পাঠের প্রয়োজনীতা অনেক। পাঠক তৈরির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যেমন: গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সভা-সেমিনার করা, পাঠক সমাবেশ, মানসম্মত পাঠকদের সম্মানিত করা। আরেকটি হলো খণ্ডিত গণ্ডি ভাঙতে হবে। বিশ্বের নানা প্রান্তের পাঠককেও কাছে টানতে হবে। সেজন্য বাংলাভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলোর ইংরেজি অনুবাদ হতে পারে। অথবা বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তাহলে বৈশ্বিক পাঠকরাও যুক্ত হবেন।
উন্মেষ : ’কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ প্রাপ্তির সময় অনুভব কেমন ছিল? এই সম্মান আপনার গবেষণা চর্চায় কী‑কিছু পরিবর্তন এনেছে বা আনবে?
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: তরুণ লেখক ও গবেষকদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে সম্মানজনক পুরস্কার। পুরস্কারপ্রাপ্তির সংবাদ পেয়ে আনন্দে অভিভূত হয়েছি। আমরা সাহিত্যিক-সহযাত্রীরাও ভীষণ আনন্দিত হয়েছে। এটা সত্যি যে, কাজের স্বীকৃতি পেলে উৎসাহ বেড়ে যায়। পুরস্কার কাজের প্রতি আমার দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
উন্মেষ : নতুন প্রজন্মের গবেষকদের কাছে আপনার পরামর্শ কী? বিশেষ করে সামাজিক আন্দোলন, ইতিহাস বা শ্রমবিষয়ে লিখতে আগ্রহীদের জন্য?
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: অনেকে লিভিংরুমে বসে গবেষণা করতে চান। প্রকৃতি গবেষণার জন্য মাঠপর্যায়ে যেতে হয়। নিয়মিত চর্চার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তাহলে প্রত্যাশার চেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। অন্যদিকে তথ্য পেলেই সেটি ব্যবহার না করে আগে যাচাই করতে হবে। সাধারণত একটি ঘটনার একাধিক ভাষ্য থাকতে পারে। তাই ঘটনার অন্য কোনো ভাষ্য রয়েছে কি-না দেখতে হবে। ভালো গবেষণাকর্ম বেশি পরিশ্রম ও সময় দাবি করে। আজকাল এআইয়ের দৌরাত্ম বেড়েছে। এআই গবেষণা কাজের সহায়ক। কিন্তু অনেকে সহায়তা না নিয়ে এআই দিয়ে প্রবন্ধ লিখছেন। এআই-এর ভূমিকা মুখ্য হচ্ছে, লেখক হচ্ছেন গৌণ। আবার লেখাটি যে কৃত্রিম হচ্ছে, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আবার অনেকে উইকিপিডিয়ানির্ভর লিখেন। এ ধরনের প্রবণতা থেকেও বের হতে হবে। না হলে লেখক-গবেষকদের জন্য দুর্গতি রয়েছে। সবাই মিলে পরিশ্রম করে বাংলা সাহিত্যকে এগিয়ে নেবো, এটি হোক সকলের প্রত্যাশা
0 Comments